Thursday, July 1, 2021

বিশ্বাসে ভালোবাসা

বিশ্বাসে ভালোবাসা
   
"ভালোবাসা ভালোবাসে শুধুই তাকে, ভালোবাসায় ভালোবেসে বেঁধে যে রাখে"--- বুঝলে পাগল, আমাকে এড়িয়ে যাওয়া এত সহজ নয়।আমি তোমায় ভালোবাসি আর যতদিন বাঁচবো ততদিন ভালোবাসবো।সে তুমি আমার সাথে সংসার করো বা না করো। সেই প্রথম।দিন থেকে তোমায় আমি ভালোবাসি।অবশ্য তখন আমি বুঝতাম না এটাকেই ভালোবাসা বলে।কিন্তু তোমার সাথে কথা বলতে, তোমার সাথে সময় কাটাতে আমার খুব ভালো লাগতো।সেই ভালোলাগা থেকে বেরিয়ে কবে যে তোমায় ভালবাসতে শুরু করলাম সে তো আমি নিজেই জানিনা। তুমি যতই আমায় বলোনা কেন তুমি আমার বাবা-মায়ের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারবে না কারণ তাদের সাহায্যে;তোমার ভাষায় অবশ্য তাদের দয়ায় তুমি আজ এই জায়গায় পৌঁছেছো সেই কারণে।কিন্তু তারজন্য আমার ভালোবাসা তো মিথ্যে হয়ে যেতে পারে না।
  শেখর চুপচাপ মাথা নিচু করে বসে থাকে। আর অলিভিয়া অনর্গল বকবক করে নানানভাবে তার ভালোবাসা ব্যক্ত করতে থাকে।আজ এখানে আমি কেন এসেছি জানো?তুমি তো আমাকে কিছু না জানিয়ে এখানে চলে এলে।আমাকে মা পাঠিয়েছেন।যেই আমি দুদিনের জন্য একটু মামাবাড়িতে গেছি আর তুমি চলে আসার জন্য সেই সুযোগটাই নিলে।কেন বুঝতে চাওনা আমার থেকে দূরে চলে গেলেই আমার ভালোবাসা তোমায় আরও বেশি করে জড়িয়ে ধরবে। এ বাঁধন থেকে কোনদিনও তুমি বেরোতে পারবে না।
--- মাসিমা কেন তোমায় আমার কাছে পাঠিয়েছেন?
--- ওই যে যতবার তোমায় ফোন করা হচ্ছে তুমি ফোন ধরছো না।যেহেতু ফোনটা আমার মোবাইল থেকে আসছে তুমি ভাবছো আমিই ফোন করছি।কিন্তু না,ওটা মা আমাকে দিয়ে তোমার খবর নিতে ফোন করাচ্ছিলেন।কাল সারাদিন কোন ফোন করনি তাই মা ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন তোমার খবরের জন্য।অগত্যা আমাকেই পাঠালেন।আমার তো শাপে বর হল।
--- আমি তোমায় ভালোবাসি না অলি।
--- আমি বিশ্বাস করি না।
--- আমাকে তুমি বেইমান হতে বলছো?
--- এটাই হচ্ছে আসল কথা।ভালো তুমি আমায় বাসো কিন্তু যেহেতু আজ আমার বাবা মায়ের জন্য তুমি এই জায়গায় পৌঁছেছো তাই কথাটা স্বীকার করতে সাহস পাচ্ছ না।
   কয়েক বছর আগের কথা।
 দেবাশীষ চৌধুরী তার বাড়িতে কিছু কাজ করার জন্য এক হাজার ইট এনেছিলেন।ভ্যান ইটগুলি রাস্তাতেই নামিয়ে দিয়ে চলে গেছিলো।বিকালে বাড়িতে ফিরে তিনি লোক খুঁজতে বেরোন ইটগুলিকে বাড়ির ভিতরে আনার জন্য।কিন্তু ওই সময় কোন লোক না পেয়ে তিনি যখন চলে আসছিলেন তখন আঠারো উনিশ বছরের একটি ছেলে তার দিকে এগিয়ে এসে বলে,
--- কাকু,আপনি নাকি লেবার খুঁজছেন।কি কাজ করতে হবে আপনার?
দেবাশীষবাবু ছেলেটির দিকে তাঁকিয়ে দেখেন ছেলেটি ফর্সা,বেশ লম্বা।চোখ দুটি খুব মায়াভরা।পোশাক আশাকও পরিস্কার পরিচ্ছন্ন ।তিনি জানতে চান,
--- কাজটা কে করবে?আমার কিছু ইট রাস্তা থেকে বাড়ির ভিতরে নিতে হবে।
--- কাজ আমি করবো।
--- তুমি?তুমি কি পারবে? এ কাজ তুমি পারবে না বাবা।
--- পারতে তো আমাকে হবেই কাকু।আমাকে সেমিস্টারের টাকা জমা দিতে হবে কলেজে।কালই লাষ্ট ডেট।
--- তুমি কলেজে পড়?
--- হ্যাঁ।এটা থার্ড সেমিস্টার।সব টাকা যোগাড় করতে পারিনি।কলেজ থেকে আমাকে তিনদিন বেশি সময় দিয়েছে।এই তিনদিনে কিছু কাজ করতে পারলে টাকাটা জোগাড় হয়ে যাবে।
--- বাড়িতে কে কে আছেন তোমার?
--- এখন কেউ নেই।মা ছিলেন। ছমাস হল মারা গেছেন।বাবা তো আগেই অন্য একজনকে বিয়ে করে অন্যত্র সংসার পেতেছেন।অনেক কষ্ট করে মা আমায় লেখাপড়া শিখাছিলেন।মায়ের স্বপ্ন আমাকে পূরণ করতেই হবে।কয়েকটা টিউশনি করি তাতে দুবেলা খাওয়াটা হয়ে যায়।বাড়িটা নিজের।মা তার একটা একটা গয়না বিক্রি করে আমায় নিজের পায়ে দাঁড় করানোর চেষ্টা করছিলেন।কিন্তু মাঝখান থেকে করোনা মায়ের জীবনটা কেড়ে নিলো।
 দেবাশীষবাবু অবাক হয়ে ছেলেটির কথা শুনছিলেন।সেদিন ছেলেটি রাত একটা অবধি ওই ইট টেনে বাড়ির ভিতরে রেখেছে।সাথে অবশ্য দেবাশীষবাবুও ছিলেন সমানভাবে। তিনিও ইট টেনেছেন সেই রাত একটা পর্যন্ত।পড়ে অবশ্য তাকে পেইন কিলার খেতে হয়েছিল।আর শেখরকে তার স্ত্রী মিতাদেবী রাত্রে খাইয়ে ছেড়েছিলেন।যাওয়ার সময় দেবাশীষবাবু শেখরের কাছে জানতে চেয়েছিলেন,
--- কত টাকা তুমি জোগাড় করেছো?আর কত জোগাড় করতে হবে তোমাকে?
--- আমার এখনো চার হাজার বাকি।
 দেবাশীষবাবু জোর করেই তাকে ওই  টাকাটা দিয়ে দিয়েছিলেন।শেখর অবশ্য কিছুতেই টাকাটা নিতে চায়নি।সেই শুরু শেখরের জীবন গড়ার জন্য তার পাশে দাঁড়ানো।
  দেবাশীষবাবু ও মিতা দেবী সন্তান স্নেহে শেখরকে বুকে টেনে নেন।আর তাদের মেয়ে একটু একটু করে শেখরের প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়ে।শেখর যখন সেটা বুঝতে পারে তখন থেকেই অলিভিয়াকে এড়িয়ে যেতে থাকে।কারণ সে উপকারীর সাথে বেইমানী করতে পারবে না কিছুতেই।তাদের মেয়ের উজ্জ্বল ভবিষ্যত।তার মত হতদরিদ্র একটি ছেলের সাথে এগিয়ে চলা কিছুতেই সম্ভব নয়।
 দেবাশীষবাবুর অনুরোধে সে কিছুদিন ওই বাড়িতেই ছিল।কিন্তু অলিভিয়া নানান অজুহাতে তার ঘরে যখন তখন ঢুকে পড়তো।তাদের বাড়ি শেখরের কিছুই বলার ছিল না।তাই অলিভিয়া যখন দুদিনের জন্য তার মামাবাড়িতে যায় সেই সুযোগ পেয়ে শেখর তার নিজের বাড়িতে চলে আসে। শেখর, অলিভিয়া যখন ঘরে বসে কথা বলছে তখন অলিভিয়ার ফোনটা বেজে ওঠে।অলিভিয়া ফোনের দিকে তাকিয়ে দেখে বাবা ফোন করেছেন। বাবার সাথে কিছুক্ষণ কথা বলে সে ফোনটা শেখরের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে,
---বাবা কথা বলবেন তোমার সাথে।শেখর কিছুক্ষণ দেবাশীষ বাবুর সাথে কথা বলে ফোনটা অলিভিয়ার হতে দিয়ে দেয়।
  দেবাশিসবাবু কথামতো পরদিন সকাল এগারোটা নাগাদ শেখর তাদের বাড়িতে আসে।দুপুরবেলা খাওয়া-দাওয়া করে যখন দেবাশীষবাবু আর মিতাদেবীর সাথে সে কথা বলছিল তখন মিতাদেবী দেবাশীষবাবুকে উদ্দেশ্য করে বলেন,
--- এত কথা না বলে আসল কথাটা ওকে জানাও কি জন্য আজ ওকে আসতে বলেছ।
---  হ্যাঁ বলছি। শেখর বাবা আমাদের একটা মনের সুপ্ত বাসনা তোমার পূরণ করতে হবে।
--- এভাবে বলবেন না কাকু।আপনারা আমায় আদেশ করুন।যা বলবেন তাই করবো।
--- না না এখনি নয়।তবে চাকরি পাবার পর।
--- হ্যাঁ বলুন কি করতে হবে?
--- আমার মেয়েটাকে তোমার বিয়ে করতে হবে।অবশ্য তোমার আপত্তি থাকলে আমরা জোর করবো না।একমাত্র মেয়ে আমাদের।ও মুখ ফুটে যদি কিছু চায় তাহলে না বলি কি করে?আর তা ছাড়া আমাদের দুজনেরই তোমায় জামাই হিসাবে পেলে ভালো লাগবে।আশাকরি কিছুদিনের মধ্যে কিছু একটা রোজগারের ব্যবস্থা তোমার হয়ে যাবে।মেয়েটা তোমায় বড্ড ভালোবাসে।
--- আমি দরিদ্র।তবে নির্লোভ।যে ভালোবাসা আমি আপনাদের কাছ থেকে পেয়েছি সে ঋণ আমি কোনদিন শোধ করতে পারবো না।আগে চাকরি পাই তারপর এসব নিয়ে ভাবা যাবে।
 সেদিনও রাতে খেয়েই শেখরকে আসতে হয়েছিল।অনেক রাতে সেদিন বাড়ি ফেরার সময় অন্ধকারে অলিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে শেখর খুব চাপা স্বরে তাকে বলে,
--- কাল থেকে চাকরির চেষ্টাটা দ্বিগুণ করতে হবে।কারণ যত তাড়াতাড়ি চাকরি পাবো অলি তত তাড়াতাড়ি আমার হবে।এতদিন মনের কথাটা বলতে সাহস পাইনি।আজ বলে গেলাম।আর কি যেন কাল বলছিলে? 
ভালোবাসা ভালোবাসে শুধুই তাকে, ভালোবাসায় ভালোবেসে বেঁধে যে রাখে" --- একদম ঠিক বলেছিলে।

No comments:

Post a Comment