সুখের ঘরে আগুন (৪২ ও শেষ পর্ব)
বৌভাতের দিন সন্ধ্যায় পার্লার থেকে লোক আসে। কনে সাজানোর পর তারা অম্বিকাকে বলে,
--- কই ম্যাম আর একজনের সাজার কথা আছে তাকে ডাকুন।
অম্বিকা নিলয়কে ফোন করে।আর কে সাজবে তার কাছে জানতে চায়।নিলয় তাকে জানায় অচলা।তখন অচলা সামনেই ছিল।তাকে সাজতে বলা হলে সে তিড়িং করে উঠে দাঁড়িয়ে বললো,
--- অসম্ভব!দাদার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে।আমি কিছুতেই পার্লারের মানুষের কাছে সাজবো না।অম্বিকা তাকে বুঝিয়ে বলতে সে শেষমেষ রাজি হয়।
অম্বিকাকে নিয়ে গিয়ে বসানো হল।অতিথিরা একে একে সকলেই আসতে শুরু করেছেন।অচলা সেজেগুজে যখন অম্বিকার সামনে এসে দাঁড়ালো অম্বিকা তাকে দেখে বললো,
--- কি সুন্দর লাগছে তোকে অচলা।তোর এই রূপটা আমাদের চোখে পড়তো না যদি না তোর দাদা জোর করে পার্লারের লোকের কাছে তোকে সাজাতো।সত্যিই তোকে আজ ডানাকাটা পরির মতো লাগছে।
অচলা লজ্জা পেয়ে অম্বিকাকে বললো,
--- কি যে বলো তুমি বৌদি?দাদার এসব পাগলামি!আমি ভাগ্য করে একটা দাদা পেয়েছি।তবে একটা কথা ঠিক,দাদা আজ আমাকে দেখে ভীষণ খুশি হয়ে যাবে।
---আরে শুধু দাদা নয় তোকে দেখে প্রত্যেকেই তোর রূপের প্রশংসা করবে আজ।আর একজন আছে অবশ্য যে তোর এই রূপ নয় তোর মনটাকেই তার ভাল লেগেছে।এটা অবশ্য আমার ধারণা সত্যি মিথ্যা জানি না।তার চোখের চাহনি আমায় জানিয়ে দিয়েছে তোকে মনে হয় সে ভালোবেসেই ফেলেছে।অচলা বুঝতে পারল তার বৌদি নিখিলেশের কথা বলছে।সে কথাটা পাত্তা না দিয়ে এড়িয়ে গেল।হাসতে হাসতে বলল,
---দাদা মনে হয় এখনও তোমাকে দেখে পারেনি।তোমাকে দেখলে আজকে দাদা নির্ঘাত ভিরমি খাবে।কি অপূর্ব লাগছে তোমায় বৌদি।
--- জানতে চাইলি নাতো আমি কার কথা বলছি।
অচলা সে কথার উত্তর না দিয়ে বললো,
--- ওই দেখো দাদা এদিকেই আসছে।শুধু তোমায় নয় গো বৌদি আমার দাদাকেও ভারী মিষ্টি লাগছে দেখতে।
নিলয় এগিয়ে এসে অম্বিকার পাশে বসে বললো,
--- সব ঠিক আছে তো?
--- হ্যাঁ হ্যাঁ সব ঠিক আছে।কিন্তু তুমি তোমার বোনকে দেখেছো?
--- না,ওকে তো দেখতে পারছি না কোথাও ---
--- আসলে দেখতে পারছো ঠিকই কিন্তু চিনতে পারছো না --
--- বুঝলাম না তোমার কথা
অম্বিকা ইশারায় দেখিয়ে দিলো পাশে দাঁড়ানো অচলাকে।
নিলয় তার দিকে তাঁকিয়ে বললো,
--- কি সুন্দর লাগছে তোকে।সত্যিই তোকে চেনা যাচ্ছে না।
--- কার বোন দেখতে হবে তো
অম্বিকা কৃত্রিম রাগ দেখিয়ে বললো,
--- শুধু কার বোন?কার ননদ নয় কেন? আমি বুঝি ফেলনা?
--- আজ তুমি শুধু দাদার।
অচলা হাসতে হাসতে সেখান থেকে চলে গেলো।
আর ঠিক সেই মুহূর্তে সেখানে হাজির হল নিখিলেশ।নিখিলেশ ধুতি,দামী পাঞ্জাবী পরে এসেছে দেখতে পেয়ে নিলয় হাসতে হাসতে বললো,
--- আরে বিয়েটা তো আমার। তা তুই জামাই সেজে আছিস কেন?
অম্বিকা মজা করে বললো,
--- বারে,বন্ধুকে বিয়ে করতে দেখে নিজেরও একটু জামাই সাজতে ইচ্ছা করেছে।ট্রায়াল দিচ্ছে বুঝলে --- ।একটা মেয়ে দেখতে হবে এবার নিখিলদার জন্য।অবশ্য আমার হাতের কাছেই একটা মেয়ে আছে।বললে ঘটকালিটা করতেই পারি।
নিখিলেশও উদাস হওয়ার ভঙ্গিতে বললো,
--- আর কতকাল একা একা হাত পুড়িয়ে খাবো?
একথা শুনেই নিলয় ধমকের সুরে বলে উঠলো,
--- তারমানে তুই একটা রাধুনিকে বিয়ে করবি?
--- ওহ্ নিলয় !আমার কথার তুই যা মানে করলি তারজন্য তোকে একটা সেলুট না দিয়ে পারছি না।
ওদের হাসি,ঠাট্টার মাঝে হঠাৎ সেখানে অচলার আবির্ভাব হওয়াতে নিখিলেশ তার দিকে ক্যাবলার মত হা করে তাকিয়ে আছে দেখে অম্বিকা নিলয়কে একটা ধাক্কা দিয়ে কানে কানে বলে," কিছু আঁচ করতে পারছো?"
--- কিসের কি আঁচ বলো তো ?
--- তোমার বন্ধুটি তোমার বোনের প্রেমে পড়েছে
--- বলো কি ?
--- আস্তে আস্তে --- ।সবাই শুনতে পাবে।তবে অচলা বেশ খেলাচ্ছে তোমার বন্ধুটিকে।
নিখিলেশ অচলার দিকে ঐভাবে তাকিয়ে থাকায় অচলা বেশ অস্বস্তিতে পরে।সে নিলয়ের দিকে তাকিয়ে বলে,
--- দাদা তোমার অফিস কলিগরা এসেছেন।সবাই তোমায় ডাকছেন।নিলয় তরিঘড়ি উঠে চলে যাওয়ার সময় নিখিলেশের কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললো," এভাবে হ্যাংলার মত কোন মেয়েদের দিকে তাকাতে নেই।আমি আছি তো সব সমস্যার সমাধান করে দেবো।"
নিখিলেশ খুবই অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো।সে তাড়াতাড়ি ওখান থেকে সরে পড়লো।
নিমন্ত্রিত অতিথিরা একে একে সবাই যে যার বাড়ির পথে পা বাড়ালো। হাতে গোনা কয়েকজন নিকট আত্মীয়রা নিলয় আর অম্বিকাকে নিয়ে তাদের ফুলশয্যার ঘরে ঢুকলো।এরই মাঝে বেশ কয়েকবার নিখিলেশের সাথে অচলার চোখাচোখি হয়েছে।প্রতিবারই অচলা চোখ নামিয়ে নিয়ে কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।কিন্তু তার বুকের ভিতর যে অদ্ভুত এক ধুকপুকানির আওয়াজ সে ছাড়া এত লোকের মাঝেও আর কেউই জানতে পারেনি।প্রতি মুহূর্তে নিজেকে এই বলে শান্তনা দিয়েছে যে সে এ বাড়িতে আশ্রিতা।তারা তাকে এতটাই আপন করে নিয়েছে পুরনো স্মৃতিগুলি আজ তার কাছে দুঃস্বপ্ন বলে মনে হয়।এমন কোন কাজ সে এ জীবনে করতে পারবে না যাতে এ বাড়ির কোন সম্মানহানি হয়।
তখন অনেক রাত।এক এক করে যে কজন বিয়ে বাড়ীতে ছিলো সকলেই যে যেখানে পারে শুয়ে পড়েছে।অচলা একটু আগে কোলাহল পুর্ণ বাড়িতে অধিক রাতের নির্জনতায় বাড়িটাকে খুব শান্ত এবং স্নিগ্ধ মনে হওয়ায় আর নিজের চোখের পাতা বুঝতে না পারায় তার ঘর লাগোয়া বারান্দায় এসে দাঁড়ায়।সামনের দিকে তাকিয়ে দেখে অনেক দূরে একটি বড় গাছের পাতার ফাঁক থেকে চাঁদ উঁকি দিচ্ছে।মানুষ তার জীবনে ফেলে আসা সুখের অতীত নিয়ে দুঃখ করে।অচলা মনেমনে ভাবে আমার জীবনে দুঃখ পাওয়ার মত সুখের কোন অতীত নেই।সারাটাদিন পরিশ্রমের পরেও কোনদিন সে পেট পুড়ে দুবেলা খেতেও পারেনি।আর সেখানে আজ আছে সে রাজার হালে।কোনদিন সে কল্পনাও করেনি এমন একটা জীবন তার জন্য অপেক্ষা করে আছে।হয়ত নিজের অজান্তেই এমন কোন ভালো কাজ সে নিশ্চয় করেছিলো যার জন্য নিলয়দার মত একজন মানুষের দেখা সে পেয়েছিলো।বাড়ির প্রতিটা মানুষ তার কাছে ভগবান।
বেশ কয়েক বছর পরের ঘটনা ----
খুব ভোরেই অচলা আর নিখিলেশ তাদের দুবছরের ছেলেকে নিয়ে শোকস্তব্ধ বাড়িতে ঢুকেই অচলা বাবার পায়ের কাছে আছড়ে পরে কাঁদতে শুরু করে।অনেক চেষ্টা করেও কেউ তাকে সেখান থেকে তুলতে পারে না। মলিনাদেবী তখন সকলকে বলেন,"ছেড়ে দাও ওকে।লোকটা যে ওর কাছে দেবতার মত ছিলেন।দেবতার পায়ের উপর থেকে তার ভক্তকে তুলতে নেই।জন্ম না দিলেও যে বাবা হওয়া যায় তোর বাবা সেটা প্রমাণ করে দিয়েছেন।আর অচলাও তার ভক্তি,সেবা,ভালোবাসা দিয়ে প্রমাণ করে দিয়েছে সন্তানের কাছে তার বাবার স্থান কতটা উপরে।শববাহী গাড়ি উপস্থিত।নিলয় অচলার মাথার উপরে হাত রেখে বললো,
--- এবার ওঠ অচলা।বাবাকে যে নিয়ে যেতে হবে।
কোন সাড়া না পেয়ে তার হাত ধরে তুলতে গিয়ে দেখে সে অজ্ঞান হয়ে নরেশবাবুর পায়ের কাছে পড়ে আছে।শালা,ভগ্নিপতি দুজন ধরে তাকে ঘরে খাটের উপর শুইয়ে দিয়ে জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টা করতে থাকে।তার জ্ঞান ফিরে আসলে সবাই মিলে নরেশবাবুকে নিয়ে রওনা দেয়।অচলার কোলে তার ছেলেটিকে বসিয়ে দিলে সে পুনরায় তাকে বুকের সাথে চেপে ধরে হাউ হাউ করে কাঁদতে থাকে।অম্বিকা এসে তাকে শান্তনা দিতে শুরু করলে অচলা বলে,
--- বাবা তো আমার কাছে ভগবান ছিলেন।ভগবান আমায় ছেড়ে চলে গেলেন।আমার সংসারে কোন অমঙ্গল নেমে আসবে নাতো বৌদি?
--- এই তুই স্কুলের দিদিমনি?তুই এত বোকা আমি জানতাম নাতো?আমাদের সকলের আশীর্বাদ রয়েছে তোর উপর।নিখিলদার মত একজন জীবনসাথী পেয়েছিস।তোর কোল জুড়ে গোপাল ঠাকুর স্বয়ং এসেছেন।তোর সংসারে অমঙ্গল কেন নেমে আসবে?এই বুদ্ধি নিয়ে তুই ছাত্র পড়াস?
অম্বিকা অচলার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে পুনরায় বলে,
--- এবার নিজেকে সামলে নে।ছেলেটার খাবারের ব্যবস্থা কর।ওর খিদে পেয়ে গেছে।শ্মশান থেকে কিছুক্ষনের মধ্যেই সব ফিরে আসবে।আমি মায়ের কাছে যাচ্ছি।আমার মেয়েটারও কিছু খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে।ভালোমন্দ,শোক-তাপ সবকিছু নিয়েই জীবন এগিয়ে চলে।সময় তার নিজস্ব নিয়মেই চলে।তাই জীবন থেমে যায় না;থমকে যায় ঠিকই কিন্তু কখনোই থেমে যায় না।সুখের ঘরে মাঝে মাঝে দুঃখের কালো ছায়া এসে ঢেকে দেয় আবার প্রকৃতির নিয়মেই আস্তে আস্তে একটু একটু করে সেই কালো ছায়াও একসময় সরে যায়।
নিলয়,অম্বিকা,তাদের মেয়ে,অচলা,নিখিলেশ,তাদের ছেলে আর মলিনাদেবী --- আস্তে আস্তে এ বিশাল শুন্যতা কাটিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে চলেন।
শেষ