Wednesday, April 14, 2021

সুখের ঘরে আগুন (৩৪)

সুখের ঘরে আগুন (৩৪)

   রোজ রাতে কথা যেন আর ফুরাতেই চায়না দুজনের।দুজনেরই সকালে উঠতে দেরি হয় আর অফিস বেরোনোর সময় হুড়োহুড়ি পড়ে যায়।নিলয় ভুবনেশ্বর থেকে নানান সাইট ঘেটে ঘেটে অচলার প্রাইভেটে মাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়ার একটা ব্যবস্থা করে।প্রাথমিক স্তরে সেখানে কিছু টাকা পয়সা জমা করতে হবে তারপর তারা বইপত্র,নোটস, সাজেশন সবকিছু দেবে।কিন্তু পরীক্ষার সময় কোন একটি সেন্টারে গিয়ে পরীক্ষা দিতে হবে।নিলয় তার বাবার সাথে এ ব্যাপারে কথা বললে তিনি জানান,
--- কোথায় কি করতে হবে তুই আমাকে জানালে আমি সেখানে গিয়ে টাকা-পয়সার জমা দেওয়ার থেকে শুরু করে বইপত্র,নোটস,সাজেশন সবকিছুই নিয়ে আসবো।
 কিন্তু  নিলয় তার বাবাকে জানায় যে তোমাকে কোথাও যেতে হবে না সবকিছু অম্বিকা ওকে নিয়ে গিয়ে ব্যবস্থা করে দেবে।
কথাটা শুনে বাবা প্রথমে একটু থতমত খেয়ে যান।তিনি তার ছেলের কাছে জানতে চান,
--- কিন্তু অম্বিকা কিসের জন্য এসব করতে যাবে?
 বাবার কথাটা শুনে নিলয় মনে মনে ভাবে বাবাকে কথাগুলো এই মুহূর্তে বলা ঠিক হলো না;তবুও ম্যানেজ করে বলল,
--- প্রলয়ের বিয়ের সূত্র ধরে অম্বিকার সাথে তার একটি বন্ধুত্বের সম্পর্কের গড়ে উঠেছে।অচলার ব্যাপার নিয়ে অম্বিকা সাথে কথা বললে অম্বিকা নিজের থেকেই কাজগুলো করতে রাজি হয়েছে।
নরেশবাবু কথাগুলো বিশ্বাস না করলেও সেই মুহূর্তে তিনি কিছু ছেলেকে বললেন না,তবে কিছুটা হলেও তিনি নিলয় আর অম্বিকার ব্যাপার আচ করতে পারলেন।অম্বিকার হঠাৎ করেই বাড়িতে আসা,তার এক্সিডেন্টের কথা প্রলয়ের ফোন করে জানানো সবকিছু মিলিয়ে মিশিয়ে তিনি দুয়ে দুয়ে চার করলেন।তবে সেই মুহূর্তে তিনি কোন কথা তার গিন্নিকে জানালেন না। তিনি শুধুমাত্র অচলার ভর্তি এবং পড়াশোনার ব্যাপারে অম্বিকা যে তাকে সাহায্য করবে এ কথাটাই গিন্নিনে বলেন।কারণ অম্বিকা এসে যখন অচলাকে নিয়ে বেরোতে চাইবে তখন গিন্নির কাছে কৈফিয়তের মুখোমুখি হতে হবে।আর তা ছাড়া সেন্টারে যেতে গেলে ক্যান্ডিডেটকে সাথে নিয়ে যেতে হবে নিলয় তাকে জানিয়েছে।এবং প্রতিটা কাজই যে অম্বিকা করবে সেকথাও বাবাকে জানিয়ে রেখেছে।তাই গিন্নিকে এ ব্যাপারে কিছুটা না জানিয়ে রাখলে তিনি চেঁচামেচি শুরু করে দেবেন।এই ভয়েই তিনি সেই মুহূর্তেই কথাগুলো মলিনাদেবীকে কিছুটা বললেন। কিন্তু মলিনাদেবী কথাগুলো শুনে নরেশবাবুকে বলেন,
--- আমার কেন যেন মনে হচ্ছে নিলুর সাথে অম্বিকার একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছে।ও আমাদের কিছু না বললেও এই ব্যাপারে আমি সিওর।তবে সত্যিই যদি এরকম কিছু হয় আমার কিন্তু কোনো আপত্তি নেই।নিজের জীবনটাকে নিজের মত করে বুঝে নিক। আমাদের বয়স হয়েছে যেকোনো সময় আমরা যে কেউ চলে যাবো।তাই নিলু যদি এই মুহূর্তে কাউকে তার জীবনসঙ্গী করতে চায় আমাদের কোন বাধা দেওয়া উচিত নয়।তোমার এব্যাপারে কি মত? মলির মুখে কথাগুলো শুনে নরেশ বাবু বললেন,
-- একদম তুমি আমার মনের কথা বলেছ।এত বড় একটা ঘটনার পরে নিলু যদি সত্যিই অম্বিকাকে পছন্দ করে বিয়ে করে তাহলে তোমার মত আমিও খুশি হব।কিন্তু কথা হচ্ছে তার বাবা-মা সে কথা মেনে নেবেন কেন?নিলুর সাথে শালিনীর কোন সম্পর্ক গড়ে না উঠলেও তবুও তো বিয়ে হয়েছিল এটা তো অস্বীকার করা যায় না।আমরা আমাদের ছেলেকে বিশ্বাস করি তাই আমরা মেনে নিয়েছি নিলু আর তার  ডিভোর্সি স্ত্রীর সাথে কোন শারীরিক সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি।কিন্তু অন্য কেউ সেটা মানবে কেন?তবে এই ব্যাপারে আমার মনেহয় মলি নীলুর মতামত টাকেই আমাদের প্রাধান্য দেওয়া উচিত।আমরা কোন মতামত এই ব্যাপারে দেবো না। সে যদি অম্বিকাকে বিয়ে করতে চায় আমাদের পূর্ণ সমর্থন থাকবে।
  এই ঘটনার দিন পনেরো পরে অম্বিকা একদিন রাতে ফোন করে নরেশবাবুকে জানায় তারপরের দিন সে তাদের বাড়িতে এসে অচলাকে সাথে নিয়ে সেই সেন্টারে টাকা জমা দিতে যাবে।এই মুহূর্তে সে টাকাটা জমা দিয়ে দেবে কারণ নিলয় থাকে এই কথাই জানিয়েছে।নিলয় ওখান থেকেই তার টাকা অন লাইনের মাধ্যমে তাকে সব দিয়ে দেবে।নরেশবাবু তার কথা শুনে হ্যাঁ সূচক সম্মতি জানান কারণ তিনি বুঝতে পারছেন নিলয় এবং অম্বিকা অনেকটাই কাছাকাছি এসে গেছে।সুতরাং এই ব্যাপারে তিনি যদি তার কোনো মতামত ব্যক্ত করতে যান তাহলে নিলয় সন্তুষ্ট হবে না।তাই বুদ্ধিমান পিতার মত সন্তান সুখ কামনা করে তিনি সবকিছু মেনে নেন। তিনি ভেবে দেখেছেন নিলয়এই ব্যাপার অম্বিকাকে জানাচ্ছে আর অম্বিকা সেটাই নরেশবাবুকে রিলে করছে।সুতরাং নরেশবাবুর আপত্তি করা মানে বোকামির পরিচয় দেওয়া।  আর তিনি কোন অবস্থাতেই সে কাজ করবেন না।নিলয়ও তাকে আম্বিকার বলা কথাগুলোই বলে।আগে থাকতে ছেলের কাছ থেকে শোনা কথাগুলোই তিনি আর একবার অম্বিকার কাছ থেকে চুপ করেই শোনেন।ফোনটা রেখে গিয়ে অচলা এবং মলিনাদেবীকে জানিয়ে দিলেন পরদিন অচলাকে সাথে নিয়ে অম্বিকা সেন্টারে যাবে টাকা জমা দেওয়ার জন্য।তারপর মাঝে মাঝেই বেশ কয়েকবার অচলাকে অম্বিকার সাথে বেরোতে হবে।তারপর আর না গেলেও চলবে।অম্বিকা নোটস, বইপত্র, সাজেশন একাই নিয়ে আসবে এবং বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে যাবে। প্রয়োজনে অম্বিকা অচলা পড়াশোনার দায়িত্ব নেবে অর্থাৎ শিক্ষিকার দায়িত্বও পালন করবে।সব কথাগুলোই অম্বিকা নরেশবাবুকে জানিয়েছে।কথাগুলো শোনার পর সেখান থেকে অচলা যখন উঠে চলে যায়।মলিনাদেবী স্বামীকে বলেন,
--- হ্যাঁগো আমার তো মনে হচ্ছে নিলুর সাথে অম্বিকার রোজই ফোনে কথা হয়।
নরেশবাবু স্ত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে বললেন,
---হ্যাঁ আমারও ঠিক সেটাই মনে হচ্ছে।একদিক থেকে ভালোই হলো গিন্নি নিলু তো একসময় এই মেয়েটিকে বিয়ে করতে চেয়েছিল।একটা কথা ছোটবেলায় মার কাছে শুনেছিলাম জন্ম-মৃত্যু-বিয়ে বিধাতা যেখানে ঠিক করে রেখেছেন সেখানেই হবে।নিলুর জীবনে শালিনীর সাথে বিয়েটা ছিল একটা দুর্ঘটনা।আসলে ওর জীবনের গাঁটছড়া বাঁধা এই অম্বিকার সাথেই। কিন্তু সব কাজের একটা সঠিক সময় চায় তাই হয়তো এখন সেই সময়টা এসেছে।যা হোক - যা হচ্ছে ভালোর জন্যই হচ্ছে আর যা হবে ভালোই হবে।আমরা এই নিয়ে আর ভাববো না।কিন্তু ভাববো না বললেও ভাবতে হয়।মাথার মধ্যে একটা কথা ঘুরপাক খাচ্ছে অম্বিকার পরিবার অর্থাৎ অমলবাবুরা এখন নিলুকে মেনে নেবেন তো?
--- কেন মানবেন না? আমার ছেলেটা কি ফেলনা?ভালো দেখতে,ভালো চাকরি করে।
--- নিজের সন্তানকে সবাই ভালো দেখে।
 নরেশবাবু হাসতে হাসতে বলেন।
 এদিকে দুজনে এতটাই গল্পে মজেছেন যে ঘড়ির কাটাকোথা থেকে দশটার ঘরে গিয়ে পৌঁছেছে তা বোধকরি দুজনের কেউই খেয়াল করেননি।অচলা টেবিলে খাবার গুছিয়ে যখন ডাকতে এলো দুজনের তখন হুস ফিরলো।মা,বাবাকে খাবার গুছিয়ে দিয়ে অচলাও নিয়ে বসলো।এটাই নিত্য দিনের রুটিং।খেতে খেতে অচলা বললো,
---আমার খুব ভয় করছে বাবা।
---কিসের ভয়?
----আসলে তোমরা তো জানো ওই লোকগুলো যদি রাস্তাঘাটে কোথাও আমাকে দেখে ফেলে তাহলে তো চিনে ফেলবে আবার আমাকে তারা তুলে নিয়ে যাবে।
নরেশ বাবু খেতে খেতে অচলার দিকে তাকিয়ে বললেন,
--- দূর বোকা!কলকাতা শহর কি ছোট জায়গা নাকি?যে তোকে রাস্তাঘাটে দেখে ফেলবে?এরকম কিছু হবে না।তুই এসব নিয়ে ভাবিস না।সব ঠিক হয়ে যাবে।তুই শুধু মন দিয়ে পড়াশোনা কর।একদিন তুই নিজের পায়ে দাঁড়াবি, ভালো চাকরি করবি, আমরা দেখে শুনে খুব ভালো একটা ছেলের সাথে তোর বিয়ে দেবো।নরেশবাবুর কথা শুনে অচলা চোখ বড় বড় করে নরেশবাবুর মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,
-- রক্ষা করো,ওসব বিয়ে টিয়ে আমার দ্বারা হবে না।আমি  এই বয়সে এসে আমার বাবা-মাকে খুঁজে পেয়েছি। আমি তাদের ছেড়ে আমার জীবন থাকতে কোথাও যাবো না।আমি এখানেই থাকব।আর আমৃত্যু তাদের সেবা করবো।
 মলিনাদেবী সে দেখা যাবে এক্ষুনি তো তোর বিয়ে হয়ে যাচ্ছে না আর এসব ব্যাপারে আমরা কোন মতামত দেবো না তোর দাদা যা ভালো বুঝবে সেটাই করবে আর আমরা জানি তার মুখের উপর কিছু বলার সাহস তোর নেই।সুতরাং এসব চিন্তা এখন বাদ দে। কাল সকাল দশটার মধ্যেই রেডি হয়ে থাকবি অম্বিকা এখানে এসে তোকে নিয়ে বেরোবে। হ্যাঁরে ,তুই বাসে উঠতে পারিস তো?
 অচলা হাসতে হাসতে মাথা ঝাঁকিয়ে উত্তর দেয়,
--- খুব পারি।

ক্রমশঃ

No comments:

Post a Comment