সুখের ঘরে আগুন (৩৩)
এক এক করে দিনগুলি বেশ ভালই কেটে যাচ্ছে নিলয়ের। সকালে কোয়ার্টার থেকে বেরোনোর সময় ডিম সেদ্ধ, আলু সেদ্ধ ভাত খেয়ে বেরোনো, দুপুরে অফিস ক্যান্টিনে খেয়ে নেওয়া, আর সন্ধ্যায় ফেরার সময় রুটি তরকারি কিনে নিয়ে আসা।মাঝে মাঝে নিখিলেশ আসে ছুটির দিনে।আর অফিসে তো তার সাথে আড্ডা হচ্ছেই। সে বেচারাও তো একা।কোয়ার্টারে ফিরেই সেই রাতের ফোনের অপেক্ষা।নিখিলেশ দু একদিন মাঝে মধ্যে নিলয়ের কোয়ার্টারে থাকলেও এখনো কোনদিন নিলয় নিখিলেশের কোয়ার্টারে রাত কাটায়নি।ওখানে থাকলে তার অম্বিকার সাথে কথা বলতে অসুবিধা হবে মনে করে।আর তার কোয়ার্টারে ফোনটা আসলেই নিলয় নিয়ে সোজা অন্য ঘরে।
সেদিন অম্বিকার সাথে কথা বলতে বলতে নিলয় হঠাৎ করেই বলে উঠলো,
--- যে কথাটা বারবার তোমায় বলতে চেয়েছি তখন কোন না কোন সমস্যা এসে হাজির হয়েছে।
--- সেই কথাটা আমিও শুনতে চাই না।সত্যিই কথাটা খুব অপয়া।যেদিনই কথাটা বলতে চেয়েছেন সেদিনইএকটা না একটা ঝামেলা হয়েছে।
--- ঠিক আছে।তাহলে একটা গল্প শোনো।তাতে আপত্তি নেই তো?
--- না,বলো আমি শুনছি।
কলেজ জীবনে একটা ছেলে একটা মেয়েকে ভালোবেসেছিলো।কিন্তু ভালোবাসাটা ছিল এক তরফা।তাই প্রথম জীবনের ভালোবাসাটা ছেলেটার জীবনে স্থায়ী হয়নি।কেটে গেছে তারপর অনেকগুলি বছর।ছেলেটি তখন কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে সুচকুরে। পাড়ার কোন এক ফাংশনে পাড়ারই একটি মেয়েকে গান গাইতে দেখে মেয়েটিকে ভালো লেগে যায় ছেলেটির। সে তার বাবা-মাকে এসে কথাটা বলে এবং বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে মেয়েটির বাড়িতে তাদের পাঠায়।কিন্তু মেয়েটা সেই মুহূর্তে বিয়ে করতে রাজি ছিল না কারণ সে নিজের পায়ে না দাঁড়িয়ে বিয়ে করতে চায় না।তাই প্রসঙ্গ তোলার আগেই ছেলেটার জীবন থেকে এ স্বপ্নটাও ভেঙে যায়।সে তার ভাগ্যকে মেনে নেয়।কিন্তু বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান এবং ভালো চাকুরে।তার বাবা মা চান তাকে বিয়ে দিয়ে সংসারী করতে।কিন্তু ছেলেটির তখন মেয়েদের প্রতিই একটা বিতৃষ্ণা জমেছে।অথচ বাবা মা নাছোড়বান্দা।শেষমেষ ছেলেটিকে বিয়ে করতে রাজি হতেই হল।বাবা-মায়ের কথামতো তাদের পছন্দ করা একটি মেয়ের সাথে তার বিয়ে ঠিক হলে সে মেনে নেয়।ছেলেটি বাবা-মা বারবার ছেলেটিকে বলে বিয়ের আগে মেয়েটাকে একবার দেখার জন্য। কিন্তু ছেলেটি তার ভাগ্যের উপর সবকিছু ছেড়ে দিয়ে মেয়েটিকে দেখতে যেতে অস্বীকার করে।বিয়ের আগের দিন বাড়িতে অনেক আত্মীয়-স্বজন এর ভিড়ে রাতের দিকে তার হবু স্ত্রী তাকে ফোন করে জানায় যে সে অন্য একজনকে ভালোবাসে তাই ছেলেটি তার সাথে ঠিক হওয়া বিয়েটা যেন ভেঙ্গে দেয়।সেই মুহূর্তে ছেলেটির মাথা প্রচন্ডভাবে গরম হয়ে যায়।শিক্ষণ্ডের মত মেয়েটি ছেলেটাকে দাঁড় করাতে চায় বিয়ে ভেঙ্গে দেওয়ার কারনে।কিন্তু ছেলেটি তার বিয়ে ভেঙ্গে দিতে অস্বীকার করে আর সেই মুহূর্ত তার অস্বীকার করা ছাড়া কোনো উপায়ও ছিল না। কারণ পরদিনই ছিল তার বিয়ে।আর এই কারণে বাড়িতে প্রচুর আত্মীয়-স্বজনের সমাগম। বিয়ে হয়ে যায় মন্ত্র পড়ে সাত পাকে ঘুরে।বিয়ের আসরে মন্ত্রের মাধ্যমে দুজনে একসাথে অঙ্গীকার করে।সব কিছু নিয়ম মেনে তাদের বিয়ে হয়।বিয়ের পর থেকে ছেলেটি রাগে মেয়েটির সাথে কোন কথা বলে না; এমনকি মেয়েটিকে এড়িয়ে যাওয়ার জন্য নানান ছুতোয় সে তার ঘরে ঢোকাও বন্ধ করে দেয়,শুধুমাত্র রাতে শোয়ার জন্য মেয়েটা ঘুমিয়ে পড়লে ঘরে ঢোকা এবং সোফায় শোয়া । ছ'মাসের মধ্যে ছেলেটি মেয়েটাকে ডিভোর্স দিয়ে দেয়।
নিলয় এ পর্যন্ত বলে চুপ করে যায়।অম্বিকা বুঝতে পারে গল্পের ছলে হলেও নিলয় তার জীবনের কথাই তাকে শোনালো। কিন্তু নিলয়কে তা বুঝতে না দিয়ে জিজ্ঞাসা করে তারপর?
নিলয় এবার হেসে পড়ে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গানের একটা কলি গেয়ে ওঠে, "তার আর পর নেই ---- " তবে জীবন এগিয়ে চলেছে।
কিন্তু আমি তো জানি গল্প এখানেই শেষ হয়নি।এ গল্প এখন অন্য খাতে বইছে।আর লেখক এখানে বিধাতা পুরুষ।তিনি শেষমেষ কি লিখতে চলেছেন তা একমাত্র তিনিই জানেন। তবে এই গল্পের নায়ক যেটা করেছে তাকে আমি সমর্থন করি। কারণ ওই মুহূর্তে অর্থাৎ বিয়ের আগের দিন বিয়েটা ভেঙ্গে দিলে প্রচুর লোক জানাজানি হত। এতে পরিবারের মানহানিটা বেশি হত।তাই তার কাজকে আমি সমর্থন করছি। কোন পুরুষই মেনে নিতে পারে না শুধু পুরুষ কেন? পুরুষ নারী কেউই বিয়ের আগের রাতে যদি কেউ শুনে তার হবু স্ত্রী বা স্বামী অন্য কাউকে ভালোবাসে তাহলে জীবনে কোনদিন ও তাদের মধ্যে সত্যি কারের ভালোবাসা গড়ে উঠবে না।আর এই কারণে গল্পের নায়কের কাজটা সম্পূর্ণ সমর্থন যোগ্য।
---তাহলে আমি এবার গল্পের নায়কের নামটা বলব কি?
--- না, কারণ সে নামটা আমি জানি
--- মানে?
একই পাড়ায় থাকার সুবাদে সবকিছুই আমার জানা আর বাকিটা অন্য কারো মাধ্যমে জেনেছি।
--- তাহলে বলো,আমি কি কোন অন্যায় করেছি।
--- একদম না,আর সে কথা তো আমি আগেই বললাম।কিন্তু একটা কথা জানতে বড্ড ইচ্ছা করছে।
--- কি কথা ?
--- পাড়ার ফ্যানশনে পাড়ার যে মেয়েটির গান শুনে তুমি একদম তার প্রেমে।পড়ে গেছিলে সেই মেয়েটিকে আমি চিনি?
ফোনের অপর প্রান্তে তখন নিলয় রীতিমত হাসছে।তাকে চুপ করে থাকতে দেখে অম্বিকা আবারও বলে,
--- কি হল বললে না?আমি চিনি তাকে?
--- চেনো।কিন্তু আমি নামটা বললে তুমি বিশ্বাস করবে কিনা জানিনা।
অম্বিকার বুকের ভিতরটা হঠাৎ করেই ধড়াস করে উঠলো।সে মনেমনে ভাবলো নিলয় তাহলে পাড়ারই অন্য কোন মেয়েকে ভালোবাসে।আর সে কিনা নিলয়কে নিয়ে কত কিছুই না ভেবেছে।মনটা তার খারাপ হয়ে গেলো।একটা কষ্ট গলার কাছে যেন আটকে গেলো।তবুও প্রাণপণে গলার স্বর অপরিবর্তিত রেখে জানতে চাইলো ,
--- বলো তার নামটা?
--- তার নামটা আমি বলছি কিন্তু নামটা শুনলে তোমার বিশ্বাস হবে তো?
--- কেন বিশ্বাস হবে না?প্রথম দেখাতেই তুমি একটি মেয়ের প্রেমে পড়েছো,তাকে বিয়ে করবে বলে বাড়ির গুরুজনদের মেয়েটির বাড়িতে পাঠিয়েছো।এই কথাগুলো যদি আমি বিশ্বাস করতে পারি তাহলে তার নামটা বললে বিশ্বাস হবে না কেন?আর এতদিন ধরে তোমার সাথে আমার বন্ধুত্ব।আমরা আপনি থেকে তুমিতে এসেছি। তোমার কোন কথাটা আমি বিশ্বাস করিনি বলো তো?
--- অভিমানের সুর গলাতে।নামটা বলতে ভয় পাচ্ছিলাম।কিন্তু তোমার গলার আওয়াজ আমায় সাহস যোগালো।সত্যি বলতে কি কথাটা যদি সামনাসামনি বলতে পারতাম ভীষণ ভালো লাগতো।কিন্তু সে সুযোগটাই আমি কোনদিন পেলাম না।
অম্বিকা চুপ করে কথা শুনছিল আর তার চোখের কোন বেয়ে নোনতা জল গড়িয়ে পড়ছিল।নিলয় বলে ওঠে,
--- হ্যালো অম্বিকা শুনতে পারছো?
অম্বিকা চোখের জলটা মুছে নিয়ে বললো,
--- হু
বেশি কথা সে বললো না কারণ নিলয় যদি আবারও বুঝে ফেলে তার গলার আওয়াজ শুনে যে সে কাঁদছে।
--- যার গান শুনে আমি সেদিনই যে মেয়েটাকে ভালোবেসে ফেলেছিলাম সে আর অন্য কেউ নয়,সে তুমি।
কথাটা বলেই নিলয় ঢোক গিলে আবার বললো,
--- আমার কথাটা তোমার হয়তো ভালো নাও লাগতে পারে।কিন্তু প্লিজ আমার সম্মন্ধে কোন খারাপ ধারণা করোনা।আমি সত্যিই তোমায় ভালোবাসি।
অম্বিকা যেন তার নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছে না।বুকের কাছের নাইটিটা তুলে চোখ দুটো ভালো করে মুছে নিয়ে হাসতে হাসতে বললো,
--- আজ অম্বিকা ছাড়া অন্য কোন মেয়ের নাম বললে আর কোনদিন কথা বলা তো দূরের কথা মুখও দেখতাম না।
কবের থেকে অপেক্ষা করে আছি এই কথাটা শুনবো বলে--
--- তারমানে তুমিও আমাকে ---
--- ব্যাগ মশাই আমিও তোমায় ভালোবাসি।সেই নিশিতার বিয়ের দিন থেকে।
--- তাহলে তুমি কেন আমায় বলোনি?
--- লজ্জায়! হ্যাঁ ভয়ও ছিল কিছুটা।যদি আমার ভালোবাসাটা এক তরফা হয়।
--- আমরা দুজনেই খুব বোকা !দুজন দুজনকে ভালোবাসি অথচ কেউই মুখ ফুটে কথাটা বলে উঠতে পারছি না কেউ কে।
--- কবে আসবে বাড়িতে ?
--- খুব তাড়াতাড়ি।আসলে এই মুহুর্তেই তোমায় খুব দেখতে ইচ্ছা করছে।তোমার করছে না?
--- দেখা হলে এর উত্তরটা দেবো মশাই।
ক্রমশঃ
No comments:
Post a Comment