পিতৃ আদেশ
অগোছালো ঘরটাকে পরিষ্কার করতে গিয়ে অর্পিতা হিমশিম খাচ্ছে।বিয়ের পনেরদিন পর আজ অঙ্কুশ অফিস গেলো।কিন্তু এই পনেরদিনে পনেরটা কথা হয়েছে কিনা তার সাথে অর্পিতা নিজেই জানেনা।কোন পূর্ব প্রস্তুতি ছাড়া।হঠাৎ করেই একটা অচেনা অজানা লোক তাকে বিয়ে করতে চাইলো আর সেও রাজি হয়ে গেলো।কিন্তু এই ছাড়া অর্পিতার আর কোন উপায়ও ছিলো না।নিজের সন্মান বাঁচানোর জন্য একটা নিশ্চিত আশ্রয় তার একান্ত জরুরী ছিল।অঙ্কুশের কাছ থেকে এতটা নিশ্চয়তা পেয়েও সে কিছুতেই তার কাছে ফ্রী হতে পারছে না।
বাবা আর মেয়ের সংসার আজ দশ বছর ধরে।বাবা সাধারণ একটা প্রাইভেট ফার্মে চাকরী করলেও যা বেতন সেখান থেকে পান তাতে অর্পিতা তাদের সংসারটাকে খুব সুন্দর করেই চালিয়ে নিত।ছোট্ট একখানা ঘর আর এক চিলতে বারান্দা।ওখানেই রান্নাবান্না।ঘরের মধ্যে সামান্য একটু জায়গা যেখানে একজন ভালোভাবে বসে খেতে পারেনা।কিন্তু ওই সামান্য জায়গাতেই ছুটির দিনগুলোতে দুপুরে আর প্রতিদিন বাপবেটি কষ্ট করে হলেও রাতে একসাথে বসেই খান।সারাদিনের অফিসের নানান গল্প করতে করতে দুজনের খাওয়া শেষ হয়।অর্পিতা কিছুদিন ধরেই লক্ষ্য করছিল বাবা কি যেন একটা কথা বারবার বলতে গিয়েও থেমে যাচ্ছিলেন।জিজ্ঞাসা করেও কোন সদুত্তর সে পায়নি।কিন্তু হঠাৎ করেই তাদের জীবনে হল ছন্দপতন!
বেশ কয়েকদিন ধরেই অনিমেশবাবু একটু খাসির মাংস খাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করছিলেন।কিন্তু ডাক্তারের নিষেধ মনে করে অর্পিতা বাবাকে নিরস্ত করে।সেদিন ছিল অনিমেশবাবুর জন্মদিন।অফিস যাওয়ার সময় অর্পিতা বাবাকে এসে প্রণাম করে " শুভ জন্মদিন" বলাতে আনিমেশবাবু মেয়ের মাথায় হাত রেখে হাসতে হাসতে বলেন,
--- আজকে আমার জন্মদিন নিশ্চয় আমার মা আমার জন্য একটুখানি খাসির মাংস আনবে।
--- বাবা,ডাক্তারবাবু তোমায় খাসির মাংস খেতে বারবার নিষেধ করেছেন।
--- জন্মদিনে খেলে কিছু হবে নারে!বহুবছর খাই না তো।
--- ঠিক আছে।নিয়ে আসবো।কিন্তু মাত্র দুপিস।
--- হ্যারে ঠিক আছে।তোর এই কড়া শাসনে থাকলে আমি অমর হয়েই থাকবো।
--- বাবা!
অনিমেশবাবু হাসতে হাসতে বেরিয়ে গেলেন।
অর্পিতা ঘর পরিষ্কার করতে করতে এগিয়ে গেলো অঙ্কুশের বইয়ের তাকের কাছে। প্রতিটা বইই গল্পের বই।বড় বড় লেখক লেখিকাদের সমগ্র রচনাবলী।একটা একটা করে বই নামিয়ে সেগুলি ঝেড়ে মুছে পরিষ্কার করে একটা চেয়ারের উপর ঢিপ দিয়ে রাখছিলো।সব বইগুলি নামানোর শেষে হঠাৎ তার চোখে পড়ে একটা খাম। খামটা হাতে নিয়েই সে চমকে যায়।খামের উপরে অঙ্কুশের ঠিকানা থাকলেও হাতের লেখাটা যে তার খুবই চেনা।কি করে সম্ভব এটা? পরের চিঠি পড়া উচিত নয় একথা বাবার কাছ থেকেই তার শেখা।কিন্তু এ চিঠি তো তাকে পড়তেই হবে।জানতে হবে সবকিছু।
বাবার জন্মদিনে অর্পিতা দুশ গ্রাম খাসির মাংস এনে তেল মসলা কম দিয়ে একদম পাতলা করে ঝোল করে।সামান্য পায়েসও করে।বাবা বাড়িতে আসার সঙ্গে সঙ্গেই সে পায়েসটা বাবাকে খাইয়ে দেয়।কারণ খাসির মাংসের সাথে পায়েস খেলে যদি বাবার এসিড হয়ে যায়।সেদিন অনিমেষবাবু খুব তৃপ্তি সহকারে অর্পিতার রান্না মাংসটা খান।রাত দশটার দিকে দুজনে খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়েন।বাবা রোজই সকাল ছটার মধ্যে উঠে যান।কিন্তু জন্মদিনের পরের দিন সকাল আটটাতেও বাবাকে উঠতে না দেখে সে ডাকতে এসে দেখে তার গা পুরো ঠান্ডা।ডাক্টার জানিয়ে গেলেন হার্ট এ্যাটাক।
আত্মীয়স্বজন বলতে কোনকালেই কেউ ছিলনা আর্পিতাদের। দুএকজন পাড়া প্রতিবেশীর সাহায্যে বাবার কাজটা শেষ করে অর্পিতা।সমস্যা দেখা দেয় মারাত্মকভাবে ঘরভাড়া নিয়ে।জমানো যা কিছু ছিল আস্তে আস্তে শেষ হতে থাকে।এইভাবে মাস ছয়েক চলে।একদিন ঠিক সন্ধ্যার দিকে একজন দেখা করতে আসেন অনীমেশবাবুর সাথে। ছ'ফুটের কাছে লম্বা,একমাথা চুল।দেখতে মন্দ নয়।
--- আচ্ছা এটা কি অনিমেশবাবুর বাড়ি?
--- হ্যাঁ।
--- আপনি নিশ্চয় উনার মেয়ে অর্পিতা?
এবারও অর্পিতা ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানায়।
--- উনাকে একটু ডেকে দেবেন?
--- উনি নেই
--- নেই মানে?
--- আজ ছ'মাস হল উনি মারা গেছেন।
--- সেকি?অনেক দেরি করে ফেলেছি আসতে।
সেই শুরু অঙ্কুশের এ বাড়িতে আসা যাওয়া।একদিন অঙ্কুশের সামনেই বাড়ির বকেয়া দু'মাসের ভাড়া চাইতে এসে অঙ্কুশকে দেখতে পেয়ে বাড়িওয়ালী আভাসে ইঙ্গিতে অর্পিতাকে জানিয়ে দেন এখানে তার থাকা সম্ভব নয়।কারণ একাকী একটা যুবতী মেয়ের কাছে একটি যুবক ছেলেকে তিনি কিছুতেই বরদাস্ত করবেন না।আর সেদিনই বাড়িওয়ালী চলে যাওয়ার পর অঙ্কুশ অর্পিতাকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়।দু'দিন সময় চেয়ে নেয় অর্পিতা।
কালীঘাটে বাবার বাৎসরিক করে তারপরদিনই কালীঘাটে বিয়ে করে ওরা।নিশ্চিত আশ্রয়,খাওয়াপরার বন্দোবস্ত হলেও অঙ্কুশের সম্মন্ধে কিছুই জানেনা অর্পিতা।তাই সে কিছুতেই ফ্রী হতে পারে না তার কাছে।অঙ্কুশও তাকে কোন জোর করেনি এই পনেরদিনে।একটা ভালো প্রাইভেট ফার্মে চাকরী করা সৎ ছেলেটি কি কারণে অর্পিতাকে বিয়ে করলো এটাই ছিল অর্পিতার সব থেকে ভাবনার বিষয়।
অর্পিতা আস্তে আস্তে খামটা খুলে চিঠিটা বের করে।প্রথমে সে চিঠিটার উপর খুব ধীরে ধীরে হাত বুলিয়ে বাবার হাতের ছোঁয়া পেতে চেষ্টা করে।তারপর শুরু করে চিঠিটা পড়তে।
প্রিয় অধীর,
পত্রের প্রথমেই তোকে ভালোবাসা জানাই।আশাকরি ছেলে ও বউঠানকে নিয়ে ভালো আছিস।অনেকদিন তোর সাথে কোন যোগাযোগ নেই।তোর অফিসে খবর নিয়েছিলাম কিন্তু কেউই তোর বাসস্থানের কোন খবর দিতে পারলো না।তাই বাধ্য হয়ে তোর গ্রামের বাড়ির ঠিকানায় এই চিঠি ছাড়লাম।জানিনা চিঠিটা তোর হাতে পৌঁছাবে কিনা।
আমার একটি বিবাহযোগ্যা মেয়ে আছে।কোনরকমে তাকে গ্র্যাজুয়েশনটা করিয়েছি।সংসারের যাবতীয় কাজ সে পারে।বয়স হয়েছে বন্ধু,যে কোন সময় চলে যেতে পারি।মেয়েটি তাহলে পথে বসবে।তাই বন্ধুত্বের দাবি নিয়ে তোর কাছে আমার একান্ত অনুরোধ একবার তোর ছেলেটিকে নিয়ে আমার মেয়েটিকে দেখে যাস।আমার অর্পিতার ব্যবস্থা না করে গেলে আমি যে মরেও শান্তি পাবোনা।
ইতি
তোর বন্ধু অনিমেশ।
চিঠিটা শেষ করে নিজের চোখের জল মুছে আবার পূর্বস্থানে চিঠিটা রেখে দিলো অর্পিতা।সন্ধ্যায় অঙ্কুশ অফিস থেকে এসে তৈরি করা চা জলখাবার পেয়ে ভীষণ খুশি হয়।অর্পিতা এসে অঙ্কুশের পাশে সোফায় বসে।অঙ্কুশ একটু অবাক হয়।অর্পিতা বলে,
--- একটু কথা ছিল।
--- হ্যাঁ আমারও কিছু কথা ছিল।
--- তাহলে আগে আপনি বলুন আমি পরে বলছি।
অঙ্কুশ শুরু করে - আসলে হঠাৎ করে এই বিয়েটা হওয়াতে তুমি হয়তো মন থেকে মেনে নিতে পারোনি।কিন্তু বিয়েটা হঠাৎ করে হলেও বিয়েটা কিন্তু তোমার বাবা ঠিক করে রেখেছিলেন।তোমার বাবা আমার বাবাকে একটা চিঠিতে এ কথা জানিয়েছিলেন।তারা দুজন বন্ধু ছিলেন।পরবর্তীতে কবে যে তাদের যোগাযোগ বিরছিন্ন হয় তা আমার জানা নেই।আমি তখন কলকাতাতে একাই থাকতাম।মা হঠাৎ করেই চলে যান।বাবা গ্রামের বাড়িতেই থাকতেন।তার অসুস্থ্যতার খবর পেয়ে আমি গ্রামে পৌঁছালে তিনি একটি চিঠি আমার হাতে দেন।চিঠিটা হাতে পাওয়ার পর দিন তিনেক পরে বাবা চলে যান।আমি ওই চিঠির কথা ভুলেই যাই।তারপর কেটে গেছে অনেকগুলি মাস।হঠাৎ চিঠিটার কথা মনে পড়ায় সেটিকে বের করে বাবার বলা শেষ কথাটি রাখতেই তোমাদের বাড়িতে যাওয়া আর তোমায় বিয়ে করা।চিঠিটার নিচুতে তোমাদের ভাড়াবাড়ির ঠিকানাটা দেওয়া ছিল।চিঠিটা এই বাড়িতেই আছে। কোথায় রেখেছি ঠিক মনে করতে পারছি না। হাতে পড়লে তোমায় দেবো।আমি কিন্তু এ ব্যাপারে কোন মিথ্যা বলছি না।
--- আমি কি বলেছি আপনি মিথ্যা বলছেন?
--- না তবুও তোমার তো মনে হতেই পারে হঠাৎ করে তোমায় বিয়ে করতে চাইলাম কেন?
--- হূ এটা ঠিক।এটাই আমার মনে হয়েছিল।
অর্পিতা উঠে গিয়ে চিঠিটা এনে অঙ্কুশের হাতে দিয়ে বললো,
--- বইয়ের তাকে ছিল।
--- তাহলে তো তুমি সবই জেনেছো।যাক ভালোই হল।অন্তত আসামীর কাঠগড়া থেকে নামতে পারলাম।
--- পনেরদিন হয়ে গেছে আমাদের বিয়ে হয়েছে। এ ক'দিনে কথাটা বলার সময় পাননি?
--- আসলে তুমি তো আমার সাথে কোন কথায় বলো না।তাই সাহস পাইনি।আজ তুমি এসে আমার কাছে বসাতে কথা বলার সাহস পেলাম।হাসতে থাকে অঙ্কুশ।
খেয়ে দেয়ে রাতে ঘুমাতে গিয়ে অঙ্কুশ দেখে সোফার উপর আজ আর কোন বালিশ নেই।দুটো বালিশই খাটে গুছিয়ে রাখা।