দাবী নেই
বছরে একবারই অনীশ বাড়িতে আসে | এসে একমাস থাকে | আর সেটা এই পুজোর সময় | তাই বাড়ির সকলেই মুখিয়ে থাকে এই সময়টার জন্য | অনীশ চাকরি পেয়েছে আজ বছর পাঁচেক | বিয়ে করতে চায়না কারণ কলেজলাইফে সমস্ত মনপ্রাণ দিয়ে একজনকে ভালোবেসেছিলো | কিন্তু মেয়েটি তাকে প্রত্যাখ্যান করেছিল | সেই থেকে ভালোবাসার প্রতিই তার প্রবল বিদ্বেষ | বাড়ির লোকের অবশ্য এ খবর অজানা | তারা মনেকরে নুতন চাকরি একটু গুছিয়ে নিয়েই সে বিয়ে করবে | এখন বয়স প্রায় ত্রিশ ছুঁইছুঁই | বাড়ির সকলেই মনস্থির করে এবার অনীশ বাড়িতে আসলে সবাই মিলে তাকে যে করেই হোক বিয়েতে রাজি করাবে |
অনীশ বাড়িতে ফেরার পরই বাড়ির পুজোশপিং শুরু হয় | একান্নবর্তী পরিবারের সকল ভাইবোনদের নিয়ে অনীশ একটি বড় গাড়ি বুক করে হৈহৈ করতে করতে শপিংয়ে বেরিয়ে পরে | বাবা মায়ের একমাত্র ছেলে সে | এখন মাস গেলে প্রচুর টাকা ইনকাম তার | পরিবারের সকলের সাথেই একটা সুন্দর সম্পর্ক | যেদিন তারা শপিংয়ে বেরোয় সেদিন বাইরেই খেয়েদেয়ে বাড়ি ফেরে | অনীশ যে কটাদিন বাড়িতে থাকে সে কটাদিন বাড়িটা যেন উৎসবমুখর হয়ে থাকে | এই পরিবারের সেই বড় সন্তান |
এবারও অনীশ বাড়িতে ফেরার পর যে যার পুজোর লিষ্ট নিয়ে যার যার সময়মত বড়দার ঘরে হাজির হয়ে যাচ্ছে | কে কি ড্রেস কিনবে সব বড়দাকে জানিয়ে যাচ্ছে | কতটা শুনছে অনীশ তা বোধকরি সে নিজেও জানেনা কিন্তু হাসিমুখে " আচ্ছা ঠিক আছে , এবার পুজোয় এটা নুতন বেরিয়েছে বুঝি ? দারুন মানাবে তোকে "- গোছের প্রতিবারের ন্যায় উত্তর দিয়ে চলেছে | ঠিক হল মহালয়ার আগেই শপিংটা সেরে ফেলতে হবে | শপিংয়ের ঠিক আগেরদিন অনীশ সন্ধ্যার দিকে এটিএমে টাকা তুলতে বেরিয়ে গেলো | এটিএম থেকে টাকা তুলে কিছু দরকারি কাজ সেরে একটা উবের বুক করে বাড়িতে ফিরতে রাত আটটা বেজে গেলো | টুকিটাকি কিছু কেনাকাটাও করেছিল | সেগুলো টেবিলের উপর রেখে পকেট থেকে টাকা বের করতে গিয়ে দেখে না পকেটে তো টাকা নেই --- এ পকেট , সে পকেট, বুকপকেট --- নাহ কোথাও টাকা নেই | কাগজপত্র ও জিনিসপত্রগুলো নেড়েচেড়ে দেখেও পেলোনা যখন তখন সে বুঝেই গেলো নির্ঘাত টাকাগুলো রাস্তায় কোথাও পরে গেছে | মোটা অঙ্কের টাকা , বাড়িতে বললেই সকলে তাই নিয়ে টেনশন করতে থাকবে , ভাইবোনগুলোর মন খারাপ হয়ে যাবে --- তাই কাউকেই কিছু না বলে সে স্থির করে কাল শপিংয়ে যাওয়ার পথেই আবার টাকা তুলে নেবে | কিন্তু মনটা খুব খারাপ হয়ে গেলো -- টাকার পরিমানটা যে অনেক |
রাতে যাহোক দুটি খেয়ে নিয়ে নিজের ঘরে ঢুকে গেলো | কিন্তু পুঁচকেগুলি কি আর ছারে ? তারা সদলবলে বড়দার ঘরে এসে উপস্থিত | তার তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ার কারণ জানতে সকলেই উদগ্রীব | রাত তখন প্রায় এগারোটা | হঠাৎ কলিং বেলের শব্দে সকলের কান খাড়া হয়ে গেলো | এ ওর মুখের দিকে তাকায় | অনীশ খাট থেকে নেমে দরজার দিকে এগিয়ে গেলো | মা বললেন ,
-- ওরে আমি তো গ্রীলে তালা দিয়ে দিয়েছি চাবিটা নিয়ে যা | এতরাতে কে আবার এলো ? আজকাল যা দিন পড়েছে --- মুখ চেনা না হলে গ্রীল খুলবিনা কিন্তু |
মা তার মত বলে চলেছেন অনীশ চাবি নিয়ে লাইট জ্বালিয়ে এগিয়ে যায় গ্রীলের কাছে |
--- একি আপনি ?
--- হ্যাঁ স্যার --- আসলে এতরাতে আসবোনাই ভেবেছিলাম কিন্তু এতগুলো টাকা --- টেনশনে আপনার তো ঘুমই আসবেনা | আর তাছাড়া আমি সারারাতই প্রায় গাড়ি চালাই | এই নিন স্যার আপনার টাকা | সিটের উপরেই পরে ছিল | ভ্যাগিস আপনাকে এই বাড়ির ভিতর ঢুকতে দেখেছিলাম তাই তো দিতে আসতে পারলাম | সাধারণত প্যাসেঞ্জার নেমে গেলে পিছনের দিকে খেয়াল করে দেখা হয়না | কিন্তু আজ আপনাকে নামিয়ে দেওয়ার পরেই আমার বাড়ি থেকে ফোন আসে আমার স্ত্রীর শরীর খারাপ বলে | সঙ্গে সঙ্গেই বাড়িতে ছুঁটে যাই | তাকে গাড়িতে তুলতে গিয়ে দেখি সিটের উপরে টাকাগুলি পরে আছে | আমি তখনই বুঝতে পেরেছি এগুলো আপনারই টাকা | আমি অবশ্য গুনে দেখিনি | দেখুন টাকাটা ঠিক আছে কিনা |
অনীশ গ্রীল খুলে হাত বাড়িয়ে টাকাটা নিয়ে তাকে ঘরের ভিতরে ডাকে | প্রথম দিকে একটু ইতস্তত করলেও পরে ঢুকতে ঢুকতে বলেন ,
--- স্ত্রীকে হাসপাতালে ভর্তি করেই ছুঁটে এসেছি আপনার টাকাটা দিতে |
--- কি হয়েছে আপনার স্ত্রীর ? কে কে আছেন আপনার বাড়িতে ?
--- ওই আমরা দুজনেই | তৃতীয়জন আসতে চলেছে |
কথাটা বলে ভদ্রলোক একটু হাসেন | তারপর বলেন ,
--- একটা সময়ে বেশ ভালো চাকরি করতাম | মায়ের পছন্দ মত বিয়ে করে সুখীও ছিলাম | আসলে অঙ্কিতা খুব ভালো মেয়ে | যে কোন পরিস্থিতির সাথে যে সে মানিয়ে নিতে পারে তার প্রমাণ সে বহুবার দিয়েছে |
অঙ্কিতা নামটা শুনে অনীশের বুকের ভিতরটা ছ্যাৎ করে ওঠে | কিন্তু পরক্ষণেই ভাবে একই নাম তো অনেকেরই থাকতে পারে |
--- তা আপনার চাকরি গেলো কি করে ?
--- খুব বড় একটা কোম্পানিতে ক্যাশিয়ার পদে ছিলাম | চুরির অপবাদে চাকরি গেলো | ফাঁসিয়ে দিলো আমায় | সবই ভবিতব্য |জেলেই থাকতাম হয়তো | কিন্তু অঙ্কিতার বাবা একজন নামকরা উকিল জজকোর্টের | সেই সময় তিনিই বাঁচিয়ে দেন | এখন অবশ্য তিনি আর জীবিত নেই |ঠাকুরপুকুর বিবেকানন্দ কলেজ থেকে পাশ করেছিল ও | ওর বাবার জন্যই রক্ষা পেয়েছিলাম | তারপর আর কি করবো ? মা ও এ কষ্ট সহ্য করতে না পেরে ঘুমের মধ্যেই চলে গেলেন একদিন | আর অঙ্কিতার পরামর্শ মত এই উবের চালিয়ে সংসারটাকে ধরে রেখেছি |
অনীশের আর বুঝতে অসুবিধা হলনা এ অঙ্কিতা তার সেই অঙ্কিতা | বুকের ভিতর একটা চিনচিনে ব্যথা অনুভব করতে লাগলো | ঘর থেকে ততক্ষণে একটু মিষ্টি আর জল এনে টেবিলে রেখেছে কেউ | জলটা খেয়ে ভদ্রলোক উঠে দাঁড়িয়ে বুকের কাছে হাতদুটি জোর করে বললেন ,
--- তাহলে আসি দাদা | টাকাটা কিন্তু এখনো আপনি গুনে নেননি |
অনীশ কিছুটা অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল | ভদ্রলোকের কথাই সম্বিৎ ফেরে | আমার হারিয়ে যাওয়া টাকা যে এতো রাতে আমায় ফেরৎ দিতে এসেছেন সেখান থেকে যে একটা টাকাও সরেনি তা আমি না গুনেই বুঝতে পারছি | একটা অনুরোধ ছিল দাদা --|
--- হ্যাঁ বলুন
--- যদি কিছু মনে না করেন আমি যদি নবাগত অতিথির জন্য কিছু টাকা দিই ---
ভদ্রলোকটি আবারও হাত জোর করে বললেন ,
-- ক্ষমা করবেন আমি নিতে পারবোনা | ওর জন্য শুধু আশীর্বাদ করবেন |আসি দাদা -- আমাকে আবার হাসপাতালে যেতে হবে |
বেরিয়ে গেলেন ভদ্রলোকটি | পিছন পিছন অনীশ ও বেরিয়ে আসলো | যতদূর গাড়িটা দেখা যায় অনীশ তাকিয়ে থাকলো | গাড়িটা আস্তে আস্তে তার দৃষ্টিসীমার বাইরে বেরিয়ে গেলো ঠিক তার ভালোবাসাটা যেভাবে হারিয়ে গেছে |
No comments:
Post a Comment