জীবনের গল্প
আমাদের জীবনে এমন অনেক ঘটনাই ঘটে আমরা তারজন্য মোটেই প্রস্তুত থাকিনা | কিন্তু পরিবেশ পরিস্থিতির চাপে পরে আমাদের সেগুলি মেনে নিতে হয় | বিসর্জন দিতে হয় তখন জীবনে দেখা অনেক স্বপ্নের , হারিয়ে ফেলতে হয় নিজের ভালোলাগা মন্দলাগাকে | অন্যকে ভালো রাখা , আর অন্যের মতামতের উপর ছেড়ে দিতে হয় নিজের স্বত্বাকে |
দিদির বিয়ে ঠিক হওয়ার পর থেকেই খুব আনন্দে ছিল মনোনীতা | বড় বোন মনোবীণা | প্রাইমারী স্কুল শিক্ষক মনোতোষ ভাদুড়ীর দুই মেয়ে | বড়টি ইতিহাসে এমএ করে চাকরীর চেষ্টা করছে | কিন্তু জুতসই কিছু না পেয়ে একটি কোচিং সেন্টারে কয়েকমাস যাবৎ পড়াচ্ছে | আর এদিকে মনোনীতা পদার্থবিদ্যায় অনার্স করছে | মা মারা গেছেন বছর তিনেক |দুবোনেরই ইচ্ছা বাবার মত শিক্ষকতা করার | এদিকে মনোতোষবাবু একটি সুপাত্রের সন্ধান পেয়ে মনোবীণাকে অনেক বলেকয়ে রাজি করান | পাত্রের আগে একটি বিয়ে হয়েছিল | দুবছরের মাথায় সন্তান ভুমিষ্ট হতে গিয়ে তিনি মারা যান | দূর সম্পর্কের এক পিসিই ওই বাচ্চাটিকে দেখাশুনা করছেন | কিন্তু পিসির বয়স হয়েছে | একটানা ছমাস ধরে সদ্য পত্নীহারা ভাইপোটির কানের কাছে ভ্যা ভ্যা করে তাকে পুণরায় বিয়েতে রাজি করান | ভাইপো অতীন নন্দী পুলিশের এক উচচপদস্থ কর্মচারী |
বিয়ের দিনসাতেক বাকি | মনোবীণা সেদিন কোচিং সেন্টার থেকে বেরিয়ে মেইন রাস্তা দিয়ে না এসে সর্টকার্টে আসার জন্য অলিগলি দিয়ে রওনা হয় | সেদিনই সে সেন্টারে বলে এসেছিলো আগামীকাল থেকে সে আর পড়াতে আসবেনা | বোনের সাথে তার কথা হয়েছিল সে ফিরলে পাড়ার বিউটিপার্লারে দুজনে মিলে যাবে |
নিদ্দিষ্ট সময় পার হয়ে যেতেই মনোনীতা তার দিদিকে বারবার ফোন করতে থাকে | কিন্তু প্রতিবারই সে শোনে 'সুইচ অফ |' বাবাকে সব জানালে তিনি সঙ্গে সঙ্গেই কোচিংসেন্টারে গিয়ে খোঁজ নিয়ে জানেন সে ছুটির অনেক আগেই সেখান থেকে বেরিয়ে গেছে | মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পরে | সারাটা রাত উৎকণ্ঠা আর উদ্বেগের মধ্য দিয়ে কাটিয়ে লজ্জার মাথা খেয়ে তিনি তার হবু জামাইকে সব খুলে বলেন যদি কোন সুরাহা সে করতে পারে কারণ সে একজন পুলিশের উচচপদস্থ কর্মচারী |
অতীন নন্দী এমনিতে খুবই ভালো মানুষ | কিন্তু রাগী পুলিশ অফিসার বলে তাকে অফিসের সকলেই একটু সমীহ করে চলে | মনোতোষবাবুর কাছে সব শুনে প্রথমে সে একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় | বিয়ের আর মাত্র ছদিন বাকি | এর মধ্যে বিয়ের কনে উদাও তা আবার নিজের জীবনের | তবুও তিনি মনোতোষবাবুকে আস্বস্ত করেন যেভাবেই হোক তার মেয়েকে তিনি খুঁজে বের করবেন | যতটা পারা যায় তিনি যেন কথাটা পাঁচকান না করেন |
না মনোবীণার কোন খোঁজ পাওয়া যায়না | বিয়ের মাত্র দুদিন বাকি | মনোতোষবাবু তড়িঘড়ি বসবাসের এলাকা ছেড়ে অন্যত্র ভাড়া নিয়ে উঠে যান | হাতেপায়ে ধরে অতীনকে রাজি করান তার ছোটকন্যাটিকে বিবাহের জন্য | ঘটনাগুলো এতো তাড়াতাড়ি ঘটে যায় যে কেউ কারো মনেরকথা বা মতামতটাও সেভাবে কাউকেই জানাতে পারেনা | এদিকে দিদিকে খুঁজে না পাওয়ার শোক , বাবার সম্মানহানির ভয় অপরদিকে নিজের স্বপ্নের আশাভঙ্গের বেদনায় মনোনীতা পুরোপুরি চুপসে যায় --- |
আত্মীয়পরিজন বর্জিত অবস্থায় শুধুমাত্র কিছু কাগজে সইসাবুত করে মনোনীতার বিয়ে হয়ে যায় তার দিদির জন্য নির্বাচিত পাত্রের সাথে | বুকে এক ভারী পাথর চাপা দিয়ে বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে চলে যায় রেজিস্ট্রি অফিস থেকেই অতীন নন্দীর বাড়ি | দু একবার চোখাচোখি হলেও তার সাথে অতীনের সেরূপ কোন কথা হয়না | সে কিছুতেই অতীনের কাছে ফ্রি হতে পারছেনা | যাকে সে মনেমনে জামাইবাবু হিসাবে কল্পনা করেছে তাকে স্বামী হিসাবে মেনে নিতে তার যেন কোথাও একটা বাঁধছে | অতীনের ঘরে ঢুকে চুপচাপ খাটের উপর বসে ছিল | হঠাৎ ছমাসের ছেলেটিকে নিয়ে পিসিমা ঘরে ঢুকলেন ,
--- এই নাও তোমার ছেলে | আজ থেকে ওর সব দায়িত্ব তোমার |
হায়রে নারী জীবন ! জীবনে কি ভেবেছিলো আর কি হল ! হাত বাড়িয়ে বাচ্চাটিকে কোলে নেয় মনোনীতা | সে তখন ঘুমাচ্ছিলো | পিসিমা বললেন ,
--- খুব শান্ত ছেলে তোমার | পেট ভরা থাকলে মোটেই কান্নাকাটি করেনা | আমি আস্তে আস্তে তোমাকে সব শিখিয়ে দেবো | একটুও ভেবোনা | যা কপালে ছিল তাতো মানতেই হবে | তবে আমার দৃঢ় বিশ্বাস অতীন ঠিক তোমার দিদিকে খুঁজে বের করবে | কিন্তু তার জীবনটা কিভাবে কাটবে সেটাই ভাবাচ্ছে আমায় | না, মা একদম চোখের জল ফেলোনা | সব ঠিক হয়ে যাবে |
সেদিন রাতে পিসিমা নাতী সমেত তার কাছে ঘুমান | যেহেতু দুধের শিশু তাই রাতে তাকে একবার উঠে দুধ গুলে খাওয়াতে হয় যা পিসিমাই করেন | কিন্তু মনোনীতা উঠে বসে পিসিমার কাজগুলিকে লক্ষ্য করতে থাকে | পরেরদিন হোটেল থেকেই খাবার আসে জনা দশেক লোকের জন্য | বাচ্চাটি সবসময়ের জন্যই মনোনীতার কাছেই থাকে | কোন সাজ ছাড়াই একটা নূতন শাড়িতে হালকা গয়নায় মনোনীতাকে অপূর্ব লাগছিলো | পাশের বাড়ির বৌদি তাকে সাজাতে আসলেও সে সবিনয়ে জানিয়ে দেয় সাজতে তার ভালোলাগেনা | রাতে পিসিমা ছেলেকে নিতে আসলে মনোনীতা তাকে তার কাছেই রেখে দেয় | সকালের দিকে বাবা একবার তার সাথে দেখা করে গেছেন | কিন্তু সেরূপ কোন কথাই হয়নি | দিদির চিন্তায় বাবা যে খুবই উদ্বিগ্ন তা বাবার চেহারাতেই স্পষ্ট | বারবার পিসিমা বলা স্বর্তেও তিনি কিছুই খাননা |
নিয়মমাফিক সেদিন মনোনীতার ফুলশয্যা | অনেক রাত্রে অতীন একটি বড় ব্যাগ নিয়ে ঘরে ঢোকে | অর্ক তখন ঘুমাচ্ছে | ব্যাগটা দেখেই মনোনীতা চিনতে পারে এটা তাদেরই ব্যাগ | ব্যাগটা রেখে সে খাটের উপর গিয়ে বসে বলে ,
--- যা ঘটেছে তার জন্য আমরা কেউই প্রস্তুত ছিলামনা | আপ্রাণ চেষ্টা করছি তোমার দিদিকে খুঁজে বের করতে | কিন্তু কোন দিক থেকেই কোন ক্লু পাচ্ছিনা | খুঁজে তাকে ঠিকই পাবো | কিন্তু তোমার কাছে আমার একটা অনুরোধ আছে ----
--- বলুন
--- তোমার বাবাকে ফোনে জানিয়েছিলাম তোমার বই খাতা এখানে দিয়ে যেতে | ওই ব্যাগে সেগুলো আছে | পড়াটা মাঝপথে বন্ধ করা ঠিক হবেনা | নিজেকে আগে তৈরী করো | জীবন একটাই | স্বপ্নগুলোকে পূরণ করো | আমি কখনোই স্বামী হিসাবে তোমার প্রতি কোন জোর খাটাবোনা | আগে লেখাপড়াটা শেষ হোক তারপরে নাহয় অন্যকিছু ভাবা যাবে | পিসিমা তো আছেন অর্ককে দেখার জন্য | তিনি ওকে খুব ভালোবাসেন | ওর কোন কষ্ট হবেনা এটা আমি জানি | তোমাকে বিয়ে করতে আমি বাধ্য হই শুধুমাত্র ওই বয়স্ক লোকটার কথা ফেলতে পারিনি বলে | তিনি আমার হাতদুটি ধরে কেঁদেই দিয়েছিলেন | আমার থেকে তুমি অনেকটাই ছোট | আমিও সেই মুহূর্তে কিংকর্তব্যবিমূড় হয়ে পড়েছিলাম | যাহোক অনেক রাত হল | তুমি ঘুমিয়ে পড়ো | আমি ওই সোফাকাম বেডটা খুলে শুয়ে পড়বো | আর হ্যাঁ আমি যতদূর জানি অর্ককে রাতে একবার খাওয়াতে হয় ; তুমি ওকে রেখে দিলে পারবে রাতে ও কাঁদলে খাওয়াতে ?
মনোনীতা ঘাড় নেড়ে জানায় যে সে পারবে | ভোররাতে লাইট জ্বালানো দেখে অতীন উঠে বসে দেখে মনোনীতা পরম মমতাই তার অর্ককে দুধ গুলে খাওয়াচ্ছে | কোনদিকে তার কোন নজর নেই | কিছুক্ষণ বসে থেকে সে আবার শুয়ে পরে |
ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠেই বাসি জামাকাপড় ছেড়ে সে রান্নাঘরে ঢোকে | ততক্ষণে পিসিমা উঠে চায়ের জল চাপিয়ে দিয়েছেন | পিসিমা তাকে দেখে একগাল হেসে পরে বললেন ,
--- এই হচ্ছে নারী জীবন | বুকে কষ্ট চেপে রেখে বাস্তব অবস্থার সাথে নিজেকে মানিয়ে নেওয়া | কিন্তু মা অতু আমায় বলেছে তোমায় যেন আমি কোন কাজ করতে না দিই | তুমি কি পড়ছো সেটা আগে শেষ হবে তারপর আমার ছুটি | তবে আমি জানি আমৃত্যু আমায় অতু ছাড়বেনা | আমি যে একা থাকি | আমারও ভালো হল ছেলে , বৌ, নাতী সব নিয়েই আমার দিন কেটে যাবে |
--- পিসিমা আজ তো আর পড়া হবেনা তুমি বরং অর্কের কাছে যাও কি রান্না করতে হবে আমায় বলে দাও | আজ আমিই করি সব | আর হ্যাঁ তুমি যখন অর্ককে স্নান করাবে আমায় ডেকো আমি দেখে নেবো |
--- খুব লক্ষ্মী মেয়ে তুই মা | আমার আর কোন চিন্তাই থাকলোনা | বিয়ে ঠিক হওয়ার পর আমার খুব চিন্তা হত যদি দাদুভাইকে সে ঠিকমত না দেখে , যদি সে সংসারের দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন না করে --- আজ সব চিন্তা থেকে মুক্ত হলাম |
অতীন অফিস যাওয়ার জন্য তৈরী হয়ে খাবার টেবিলের কাছে এসে দাঁড়ায় | পিসিমা তাকে চা দিতে গিয়ে সকালের রান্নাঘরের সবকথা অতীনকে বলেছেন আর বৌমার খুব প্রশংসাও করেছেন | মনোনীতা খাবারের থালা হাতে ঘরে ঢুকে দেখে অতীন খুব মন দিয়ে পেপারটা দেখছে | থালাটা টেবিলে নামিয়ে রেখে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে , অতীনের কোন ভ্রুক্ষেপই নেই | পরে বাধ্য হয়েই বলে ,
--- আপনার খাবার দিয়েছি |
পেপারটা গুছিয়ে অতীন খেতে শুরু করে | খেতে খেতেই বলে ,
--- কাল থেকে পুরোদমে পড়াশুনা শুরু করবে | কলেজেও যেতে হবে কিন্তু | অর্ককে পিসিমাই সামলে নেবেন আগের মত |
মনোনীতা অবাক দৃষ্টিতে অতীনের দিকে তাকিয়ে থাকে আর মনেমনে ভাবে ' কত সুন্দর মনের মানুষটা , দিদির কপালটা সত্যিই খুব খারাপ '
--- একটা কথা বলার ছিল আপনাকে |
--- হ্যাঁ বলো --
--- দিদির ব্যাপারটা ---
--- প্রশাসন যথাসাধ্য চেষ্টা করছে আশা করছি কয়েকদিনের মধ্যেই কিছু একটা খোঁজ পাবো | কিন্তু তোমার কাছে একটা অনুরোধ ছিল --
--- অনুরোধ কেন ? আপনি বলুন আমি নিশ্চয়ই শুনবো |
--- অন্যকিছু নয় যদি সম্ভব হয় আমায় তুমি করে কথা বোলো | এই আপনি আজ্ঞেটা আমার ঠিক ভালো লাগছেনা শুনতে |
মনোনীতা মাথা নেড়ে সম্মতি জানায় | অফিস বেরিয়ে যায় অতীন | অর্কের স্নানের সময় পিসিমা মনোনীতাকে ডেকে নেন | এরমাঝে অর্ক একবার দুধ খেয়েছে | পিসিমার সাথে গল্প করতে করতে মনোনীতাই তাকে ফিডিংবোতলে দুধ খাইয়ে দিয়েছে | ঠিক রাত্রি নটা নাগাদ অতীন হাতে একটা বড় ব্যাগ নিয়ে বাড়ি ঢোকে | নিজের ঘরে সেটা রেখে পিসিমা ও মনোনীতার সামনে বলে ,
--- তোমার তো শাড়ি পরার অভ্যাস নেই | শাড়ি পরে বাসে করে কলেজে যাতায়াতও করতে পারবেনা | কিছু নাইটি ও চুড়িদার এনেছি | ওগুলো তোমার | শাড়ি পরার সময় অনেক আছে তখন পরো | আমি আজ রাত বারোটা নাগাদ বেরোবো | কখন ফিরবো বা কবে ফিরবো বলতে পারছিনা | তোমরা সবাই সাবধানে থেকো | কোন অসুবিধা হলেই আমায় ফোন কোরো |
এর ঠিক দুদিন পর অতীন বাড়ি ফেরে দুপুর নাগাদ | সেদিন ছিল রবিবার | বাড়িতে ফিরে ফ্রেস হয়ে মনোনীতার দেওয়া খাবার খেতে খেতে অতীন বলে ,
--- বোসো কথা আছে |
মনোনীতা একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসে |
--- তোমার দিদিকে পাওয়া গেছে |
আনন্দে আত্মহারা হয়ে মনোনীতা বলে ওঠে ,
--- কোথায় ? কবে ? দিদি এখন কোথায় ?
--- বলছি সব বলছি ---
পাড়ার একটি ছেলে বার কয়েক তোমার দিদিকে তার ভালোবাসার কথা বলেছিলো | কিন্তু প্রতিবারই তোমার দিদি তাকে প্রত্যাখ্যান করেছে --
--- হ্যাঁ জানি তো --- দীপকদা
--- কিন্তু তুমি বা তোমার বাবা কেউ কিন্তু আমাকে একবারও সে কথা জানাওনি | যদি জানাতে তাহলে অনেক আগেই তাকে খুঁজে পেতাম | যাহোক --- দীপক খুব একটা ভালো ছেলে নয় |চুরিডাকাতি আর ছোটখাট অপরাধের সাথে সে জড়িত | কিন্তু এবারের অপরাধটা তার একটু বেশি ছিল | একজনকে খুনের ব্যাপারে সে খুনিকে মদত দিয়েছিলো |
--- আপনি মা ---- নে তুমি দিদির কথা
বলো |
অতীন মনোনীতার মুখের দিকে তাকিয়ে বললো ,
--- দিদির কথা জানতে গেলে এই ঘটনার কথাটা তো শুনতে হবে -- | সেদিন তোমার দিদি যখন গলির পথ ধরে বাড়ির দিকে আসছিলো তখন দীপক আর তার বন্ধুরা তাকে অজ্ঞান করে গাড়িতে তুলে দীঘা নিয়ে যায় | গলির মুখে ঢোকার সাথে সাথেই তারা লাইটপোষ্টের আলো সব নিভিয়ে দেয় | ফলে অন্ধকারের মধ্যে কেউই কিছু দেখতে বা জানতে পারেনা | আর ওখানে কোন দোকানপাটও ছিলোনা | সেখানে নিয়ে গিয়ে দীপক তাকে রোজ দিনে রাতে একাই ভোগ করতে থাকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে | বলা ভালো তাকে চব্বিশঘন্টায় তিন থেকে চারবার ধর্ষণ করতে থাকে | পালাবার বা কাউকে বলার আপ্রাণ চেষ্টা করেছে সে | প্রতিবারই বিফল হয়েছে | হোটেল থেকে সে যখন বেরোতো তাকে বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে দিয়ে তবে বেরোতো | হোটেলের যে ছেলেটি তাদের খাবার পৌঁছে দিতো রুমে বেরোনোর সময় তাকে বাইরে পাহারায় রেখে তবে যেত সামান্য কিছুক্ষণের জন্য | ফোনটাকে বাথরুমে গেলেও সাথে নিয়ে যেত |
এই ঘটনার কয়েকদিন আগেই বহরমপুরে একটি খুন হয় একটি টাকার ব্যাগকে কেন্দ্র করে | প্রথমে দীপক ও তার দলবলের উদ্দেশ্য ছিল পাঁচলক্ষ টাকার ব্যাগটি ছিনতাই করার | কিন্তু লোকটির চিৎকার চেঁচামেচিতে তাকে খুন করে তারা | এই খুনের কিনারা করতে গিয়ে দীপকের নামটা উঠে আসে | দীপককে খুঁজতে দীঘা পুলিশের সাথে আমরা যখন দীঘার ওই হোটেলে পৌঁছাই তখনই তোমার দিদিকে দেখতে পাই | আমরা প্রথমে তাকে সাথে করে থানায় নিয়ে আসি কিছু ফর্মালিটি শেষ করে আজই থানায় তোমার বাবার হাতে তাকে ছেড়ে দিই --
--- কিন্তু দিদির এখন কি হবে ?
--- কি আর হবে ? এই ঘটনার জন্য তো সে নিজে দায়ী নয় --- মাথা উঁচু করে বাঁচবে | কয়েকবছর পরে এই ঘটনা কেউ মনেও রাখবেনা | জীবন থেমে থাকার জন্য নয় | চাকরির চেষ্টা করবে , নিজের জীবনটাকে নিজের মত করে সাজাবে | দিদিকে জানিয়ে দিও আমরা তার সাথে আছি | যেকোন দরকারে যেন ফোন করে |
কেটে গেছে বেশ কয়েকটা বছর | অর্ক এখন ক্লাস সিক্সে পড়ে | পিসিমা এখন আর কিছুই করতে পারেননা | রান্নার লোকেই রান্না করে দিয়ে যায় | সুখী দাম্পত্য জীবন তার এখন | মনোনীতা এখন একটা কলেজে পড়ায়| বাবা চলে গেছেন বছর দুয়েক আগে | দিদি একাই থাকে | একটা বেসিরকারী স্কুলে সামান্য বেতনে চলে যাচ্ছে তার | বোন মাঝে মাঝে দিদির সাথে দেখা করতে আসে | মাঝেমধ্যে অবশ্য ছেলেকেও নিয়ে আসে | কিন্তু এই এতগুলো বছরেও অতীনের সাথে তার দেখা হয়নি ওই দীঘা থেকে ফেরার দিন ছাড়া | ইচ্ছা করেই সে কোনদিন বোনের বাড়িতে যায়নি | তার অভিশপ্ত জীবনের কোন আচঁ তার বোনের সংসারে লাগুক তা সে চায়নি | আত্মীয়স্বজনের সাথে ইচ্ছা করেই কোন সম্পর্ক সে রাখেনি | নুতন বন্ধুবান্ধব নুতন পাড়াপ্রতিবেশীর সাথে তার ভালোই সম্পর্ক |
কিছুদিন ধরেই অতীনের শরীরটা ভালো যাচ্ছেনা | কুশখুসে কাশি , পায়ের পাতা মারাত্মকভাবে ফুলছে | প্রথমদিকে তেমন গা না করলেও পরে ব্যাপারটা বেরে যাওয়ায় মনোনীতার জোরের কাছে সে হার স্বীকার করে ডক্টর দেখাতে যায় | ডাক্তার কিছু পরীক্ষানিরীক্ষা করতে বলেন | একটা খাবারের চার্ট তৈরী করে দেন ও রেষ্টে থাকতে বলেন | দিনসাতেক বাদে রিপোর্ট নিয়ে দুজনেই ডক্টরের কাছে যায় | ডক্টর যা বলেন তারজন্য মনোনীতা ও অতীন মোটেই প্রস্তুত ছিলোনা | রক্তে ক্রিটিনিনের মাত্রা এতটাই বেরে গেছে এক্ষুণি ডায়ালিসিস করতে হবে | ভেঙ্গে পরে মনোনীতা ভীষণভাবে | অতীন অসুস্থ্যতা স্বর্তেও তাকে শান্তনা দিয়ে চলে | তড়িঘড়ি পরদিনই চ্যানেল করে ডায়ালিসিস করা শুরু হয় | দিদির সাথে পরামর্শ করে খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দেয় কিডনীর জন্য | মনোনীতা বুঝতে পারছে একবার যখন ডায়ালিসিস শুরু হয়েছে তখন শেষ রক্ষা আর হবেনা | বড়জোর একবছর বা দেড় বছর হয়তোবা আরও কম | দুজনেরই প্লান ছিল অর্ক এখন বড় হয়ে গেছে এবার একটা বাচ্চা তারা নেবে | কিন্তু হঠাৎ বিনা মেঘে বজ্রপাতের মত তার জীবনে এ অঘটন সে কিছুতেই মেনে নিতে পারছেনা | মানসিকভাবে খুব ভেঙ্গে পরে সে | বারবার দিদিকে তার কাছে এসে থাকতে বলে | মনোবীণা এবার একটু নরম হয় | বোনকে সে ভীষণ ভালোবাসে | বোনের সুখের দিনে খবর রেখেছে কিন্তু সশরীরে কোনদিন তার বাড়ি আসেনি | আজ যখন বোন বিপদে পড়েছে এতোকরে বলছে তার কাছে গিয়ে থাকার কথা তখন তো তাকে যেতেই হবে | যে বাড়িতে তার বৌ হয়ে ঢোকার কথা ছিল --- সেই বাড়ি , সেই মানুষটার সামনে থেকে কি করে ঘুরে বেড়াবে এটাই মনে গেঁথে ছিল | কিন্তু এখন মনের সমস্ত দ্বিধা, দ্বন্ধ , সংকোচ বিসর্জন দিয়ে নিজের নিত্য প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস নিয়ে বোনের বাড়িতে এসে উপস্থিত হল | পিসিমার সাথেই থাকবে বলে সে জেদ ধরলো | বোনের কাছে এসে শুধু একবার সে অতীনের ঘরে ঢুকে সৌজন্য সাক্ষাৎ করে এসেছিলো | অতীন সবসময় ঘরে শুয়েই থাকে | মনোনীতাও ছুটিতে আছে | সপ্তাহে দুটি করে ডায়ালিসিস এখন | অবস্থা দিনকে দিন খারাপের দিকে যাচ্ছে | পরপর তিন সপ্তাহ ধরে খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়েও কোন লাভ হয়নি | কেউই যোগাযোগ করেনি | টাকার অঙ্কটাও অনেক ছিল | মাসখানেক পর একজন এসেছিলো যদিও তার ব্লাড গ্ৰুপের সাথে অতীনের ব্লাড গ্ৰুপ মেলেনি | আর তখনই মনোবীণা জানতে পারে অতীনের ব্লাড গ্ৰুপ বি -নেগেটিভ | মনোনীতার কান্নাকাটি দেখে তার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে মনোবীণা বলে ,
--- হ্যারে আমার ব্লাড গ্ৰুপটা তো বি নেগেটিভ | বাকি টেষ্টগুলো মেলে কিনা একবার গিয়ে দেখলে হয়না ? যদি মিলে যায় আমিই অতীনকে কিডনী দেবো |
--- কি বলছিস দিদি ? তোর পুরো জীবনটাই পরে রয়েছে | একা থাকিস | না এটা হতে পারেনা |
--- আমার আর জীবন ? শুধু বেঁচে আছি | জীবন তো কবেই শেষ হয়ে গেছে |
বোনকে রাজি করিয়ে অতীনকে কিছু না বলে দুবোনে মিলে কয়েকদিন নার্সিংহোম দৌড়াদৌড়ি করে সব টেষ্ট করিয়ে আশায় বুক বেঁধে রিপোর্টগুলি নিয়ে ডাক্তারের কাছে গিয়ে জানতে পারে --- মনোবীণা অতীনকে একটি কিডনী দান করতে পারে |
--- দিদি তোর পুরো জীবনটা পরে আছে | তুই এই ভয়ানক চিন্তা মাথা থেকে বের করে দে | আমার কপালে যা আছে হবে |
মনোবীণা একটু হেসে জবাব দিলো ,
--- আমার আবার জীবন ? সত্যিই কি আমার জীবনের কোন মূল্য আছে ? জীবনের কোন ইচ্ছাই তো পূরণ হয়নি | আমার জন্যই তো তোর আজ এই অবস্থা
--- প্রথম প্রথম আমার খুব কষ্ট হত কিন্তু বিশ্বাস কর অতীন এতো ভালো মানুষ ও আমার সব স্বপ্নকে বাস্তবের মাটিতে দাঁড় করাতে সর্বরকম সাহায্য করেছে | পরে আর কোন কষ্ট আমার ছিলোনা | কিন্তু হঠাৎ এ যে কি হল --- মনোনীতা ডুকরে কেঁদে ওঠে |
--- কাঁদিসনা , সব ঠিক হয়ে যাবে | আমি আছি তো | তুই কিন্তু অতীনকে এখন কিচ্ছু বলবিনা | ও সুস্থ্য হয়ে বাড়ি ফিরে সবকিছু জানবে |
--- এটা সম্ভব নয় | তুই ভুলে যাচ্ছিস অতীন কিন্তু একজন পুলিশ অফিসার | জেরায় জেরায় আমায় জর্জরিত করে দেবে | আমি আজই ওকে সব জানাবো |
রাতে খাওয়াদাওয়ার পর মনোবীণা পিসিমার ঘরে শুতে চলে যায় | পিসিমা খুব একটা ঘর থেকে এখন আর বেরোননা | কোমর যন্ত্রনায় অধিকাংশ সময় শুয়েই থাকেন | তার অতীনের যে শরীর খারাপ তা তিনি জানেন | মনোবীণা ঘরে ঢুকে দেখে পিসিমা আধশোয়া অবস্থায় --- চোখের থেকে জল পড়ছে |
--- পিসিমা আপনি কাঁদছেন কেন ? সব ঠিক হয়ে যাবে | আমি আছি তো |
--- দাদুভায়ের কপালটা একদম ভালোনা | জন্মের পরেই মাকে হারালো | তারপর জ্ঞান হওয়ার আগে থেকেই তোমার বোনকে সে মা বলে জানে | এখন বাবাকে হারাতে বসেছে |
--- কোন অমঙ্গল হতে দেবোনা আমি আমার বোনের সংসারে --- আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন পিসিমা |
আর এদিকে মনোনীতা সব খুলে বলে তার স্বামীকে | কিন্তু সে কিছুতেই রাজি হয়না | তার সেই এক গো
--- একটা মানুষকে সারাজীবনের জন্য পঙ্গু করে আমি বেঁচে থাকতে চাইনা | তুমি যেমন চেষ্টা করছো টাকার বিনিময়ে বা যারা কিডনি দান করে সেভাবে | উনি আমাদের নিস্বার্থভাবে নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এতো বড় উপকার করবেন অথচ আমাদের কাছে এসে যেমন থাকবেননা আবার কোনরকম অর্থ সাহায্যও নেবেননা | আমি কিছুতেই এভাবে বাঁচতে চাইনা | তারজন্য যদি আমার মৃত্যুও হয় আমি তাতেই খুশি হবো |
পরদিন সকালে মনোনীতা সব কথা দিদিকে জানায় | মনোবীণা সব শুনে কিছুটা সময় থ মেরে বসে থাকে | তারপর আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়িয়ে বলে ,
--- চল তো আমার সাথে একটু অতীনের ঘরে | আমি গিয়ে একটু কথা বলি |
--- আমার অনেক কাজ আছে দিদি , তুই যা না গিয়ে কথা বল |
--- আগে কথা বলে আসি তারপর দুজনে একসাথে রান্না করবো |
দুজনে গিয়ে অতীনের ঘরে ঢোকে | ডায়ালিসিস করার পর দুদিন খুব চনমনে থাকে অতীন তারপর আস্তে আস্তে নিস্তেজ হতে থাকে | আগামী পরশু আবার ডায়ালিসিস | মনোবীণার ইচ্ছা এবার ভর্তি হওয়ার পর অপারেশনটা করিয়েই অতীনকে বাড়ি নিয়ে আসবে |
--- দিদি এসছে তোমার সাথে কথা বলতে |
রুগ্ন শরীরে অতীন উঠে বসার চেষ্টা করে | দুবোনেই বাধা দেয় | শরীরেও তো জোর নেই তাই সে শুয়ে পরে পুণরায় |
--- আপনাকে তো বাঁচতে হবে | আর একমাত্র কিডনী ট্রান্সফার ছাড়া সেটা কিছুতেই সম্ভব নয় | আমরা চার চারটে মানুষ আপনার মুখের দিকে তাকিয়ে | অর্ক এখন অনেক ছোট | ওকে মানুষ করতে হবে , উপযুক্ত শিক্ষা দিতে হবে | আপনি একবারের জন্যও আমাদের সকলের কথা ভাববেননা -?-- একসময় আমার জন্য অনেক অপমান , লজ্জা সহ্য করেছেন , আমাকে আবার নুতন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখিয়েছেন বলে ভাববেন না আমি কোন ঋণ শোধ করছি |আমি আমার বোনের সিঁথির সিঁদুর অক্ষয় করতে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি | সম্পর্কে আপনি আমার ভগ্নিপতি | আমার ছোটবোনের স্বামী | সেই সম্পর্কের সূত্র ধরেই আমি আপনার বড় | সেটা বয়সে নাই হতে পারে আর ---
কথা শেষ হয়না মনোবীণার | মাঝপথেই অতীন বলে ওঠে
--- কিন্তু আপনার পুরো জীবনটা পরে রয়েছে | আপনার প্রতি এ অন্যায় আমি করতে পারবোনা |
--- কি আশ্চর্য আপনাদের ছাড়া আমার পুরো জীবনটাই যে অচল | এরপর থেকে তো আমাকেও আপনাকেই দেখতে হবে | আমি তো এখানেই থাকবো | এতগুলো মানুষের মাথায় ছাতা ধরতে গেলে তো আগে নিজেকে সুস্থ্য হতে হবে | আর দিদি হিসাবে আমার এ কথাটা আপনাকে মানতেই হবে | মনে করুন এটা আমার আদেশ |
--- মেনে নিলাম আপনার সব যুক্তি | কিন্তু দিদি হিসাবে আদেশ যখন দিলেন তাহলে ওই আপনি থেকে তুমিতে নামিয়ে দেন |
--- সুস্থ্য হয়ে দুজনে এখানেই তো ফিরে আসবো | সামনেই পুজো তাই ভাবছি যখন এখন থেকে এখানেই থাকবো এবার ভাইফোঁটায় ফোঁটাটা দিয়েই দেবো |
মনোনীতার হাতটা ধরে আবারও বলে ,
--- বোনটাকে যে আমি ভীষণ ভালোবাসি | ওর সুখই আমার সুখ | আর অর্ক তো আমাদের দুজনেরই সন্তান | আমি আসার পর থেকেই বড়মা , বড়মা করে মাথা খারাপ করে দিচ্ছে | তাহলে ওই কথাই থাকলো আগামী পরশুদিন আপনি ভর্তি হচ্ছেন আর ডক্টর যেদিন আমায় ভর্তি হতে বলবেন আমি সেদিন ভর্তি হবো |
দুইবোন ঘর থেকে বেরিয়ে আসে | বাইরে এসে দিদিকে জড়িয়ে ধরে মনোনীতা হাউহাউ করে কাঁদতে থাকে |
--- দূর পাগলী এভাবে কাঁদছিস কেন ? সব ঠিক হয়ে যাবে | এতো ভাবিসনা আমি আছি তো | আমি যতদিন বেঁচে থাকবো তোর সংসারের উপর কোন আঁচ আমি লাগতে দেবোনা | মায়ের মৃত্যুর সময় কথা দিয়েছিলাম তোকে কোন কষ্ট পেতে দেবোনা | জীবন দিয়ে হলেও সেই কথা আমি অক্ষরে অক্ষরে পালন করবো | এখন চল তো দুজনে মিলে তাড়াতাড়ি কিছু রান্না করে ফেলি |
মনোনীতা চোখ মুছে দিদির পিছন পিছন রান্নাঘরে গিয়ে ঢুকলো |