#আমার_লেখনীতে
নন্দা মুখাৰ্জী রায় চৌধুরী
বেশ করেছি
অত্যাচারী মদ্যপ স্বামীর সকল অত্যাচার মুখ বুজে সহ্য করে করে যেন সবংসহা হয়ে গেছে শ্রাবনী | কোনকিছুতেই তার আজ আর কিছু যায় আসেনা | ফিরে যাওয়ারও কোন রাস্তা নেই | রেললাইনের পাশে ঝুপড়িতে জম্ম তার | বাবা রিকশাচালক আর মা লোকের বাড়িতে রান্নার কাজ করে | অনেক কষ্ট করে শ্রাবনী ও তার ভাইকে তারা লেখাপড়া শেখাচ্ছেন | কিন্তু শ্রাবনীর পড়াশুনায় মন ছিলোনা | নবম শ্রেণী পর্যন্ত পড়েই সে পড়াশুনার ইতি টানে | এরই মধ্যে সে প্রেমে পরে বয়সে দশ বছরের বড় লরিচালক রমেশের | একদিন কাউকে কিছু না বলে রমেশের সাথে সে ঘর ছাড়ে | সদ্য যৌবনা শ্রাবনীর চোখে ছিল নুতন জীবনের অনেক স্বপ্ন | ভেবেছিলো বাবার বাড়ির দারিদ্রতা নুতন জীবনে থাকবেনা | রমেশ মাঝেমধ্যে এসে তাকে নিয়ে নানান জায়গায় ঘুরতে যেত আর বেশ ভালোমন্দ খাওয়াতো | সরল মনে শ্রাবনী ভেবেছিলো রমেশের অনেক টাকা আছে | তাই মনে অনেক স্বপ্ন নিয়ে সে তার বাবা , মা আর ভাইকে ছেড়ে ছোট একটা মন্দিরে বিয়ে করে রমেশের সাথে তার বাড়ি আসে | কিন্তু সেখানে প্রবেশ করেই সে প্রথম ধাক্কাটা খায় | বস্তির একটা ছোট্ট ঘর | চারিপাশে দারিদ্রতার ছাপ স্পষ্ট | মা অনেক কষ্টে বাড়িতে একটা গ্যাস কিনেছিলেন এখানে শত নোংরা একটি স্টোভ | একই ঘরের মধ্যে থাকা, খাওয়া আর রান্না | চোখ ফেঁটে জল বেরিয়ে আসতে চাইছে ; আপ্রাণ চেষ্টা করে চোখের জল আটকে রাখার চেষ্টা করে শ্রাবনী | প্রথম রাতের স্বামীর আদরও তার কাছে অসহনীয় হয়ে উঠে | মুহূর্তেই তার সমস্ত স্বপ্ন ভেঙ্গেচুরে খানখান হয়ে যায় যার শব্দ সে একাই বুকের মাঝে অনুভব করে , পাশের মানুষটি ঘুনাক্ষরেও টের পায়না | সেদিনের সেই ভাঙ্গা স্বপ্নকে জোড়াতালি দিয়ে বিয়ের একমাসের মাথায় লোকের বাড়ি কাজ নিয়ে অন্তত পেট পুরে দুবেলা খাওয়ার সংস্থান করে | বিয়ের পরেরদিন থেকেই সে বুঝতে পারে স্বামী তার মদ্যপ | আর মদ পেটে পড়লে তার কোন হুশ থাকেনা | তখন সে কি বলছে আর কি করছে পরেরদিন তার কিছুই মনে থাকেনা | প্রথম প্রথম কয়েকদিন সে রমেশকে বুঝানোর চেষ্টা করেছে | কিন্তু ফল হয়েছে হিতে বিপরীত | কাজ শেষ মদ খেয়ে বাড়িতে ফিরে সে সমস্ত রাগের প্রতিশোধ নেয় শ্রাবনীর শরীরে অত্যাচারের কালো দাগ ফেলে | রমেশের রোজ রাতের সোহাগ তার কাছে নিত্যদিনের ধর্ষণ বলে মনেহয় | ইচ্ছার বিরুদ্ধে নিজেকে সে আত্মসমর্পণ করে | মাঝে মাঝে নিজেকে তার শেষ করে দিতে ইচ্ছা করে | হয়তো একদিন তাইই সে করতো | কিন্তু বিয়ের ছমাসের মাথায় সে নিজের ভিতরে অন্য আর একটি প্রাণের অস্তিত্ব টের পায় | এ নিয়ে রমেশের কোন মাথা ব্যথা নেই | নিজের উদ্যোগে পাশের ঘরের দিদির সাথে সে হাসপাতালে কার্ড করে | যথাসময়ে তার একটি সুন্দর ফুটফুটে মেয়ে হয় | মাসখানেক পর থেকেই সে মেয়েকে কোলে নিয়েই লোকের বাড়ি কাজ করতে শুরু করে | তাদের ঘরের কোন একজায়গায় শুইয়ে রেখে সে কাজ করতে থাকে | কেঁদে উঠলে একটু বুকের দুধ খাইয়ে যায় | সারাদিন এই অক্লান্ত পরিশ্রম করে সন্ধ্যায় ঘরে ফিরে রমেশের খাবারের ব্যবস্থা করে | তানাহলে রমেশ ঘরে ঢুকে তান্ডব চালায় |
দেখতে দেখতে মেয়ের বয়স ছমাস হয়ে যায় | এখন সে মাঝে মধ্যে পাশের ঘরের দিদির কাছে তার মেয়েকে রেখেও কাজে যায় | দিদি খুব যত্নে তার মেয়েকে রাখে | খিদে পেলে কখনো জলে বিস্কুট গুলে আবার কখনোবা সুজি খাইয়ে দেয় যার ব্যবস্থা শ্রাবনী নিজেই করে রেখে যায় | একদিন কাজের শেষে ঘরে ফিরে মেয়েকে আনতে গেলে পাশের ঘরের রানুদি তাকে বলে ,
--- আজ রমেশ একজন ভদ্রলোক আর একজন ভদ্রমহিলাকে নিয়ে দুপুরের দিকে বাড়ি এসে কিছুক্ষনের জন্য মেয়েকে নিয়ে গেছিলো | তাদের সাথে কিসব টাকাপয়সা নিয়েও কথা বলছিলো | জানিনা কি ব্যাপার তবে তুই কাল থেকে মেয়েকে নিয়েই কাজে যাস |
খুব চিন্তায় পড়ে গেলো শ্রাবনী | কিন্তু এখন মেয়ে উপুড় হতে শিখেছে , মুখ চিনতে শিখেছে কাজের বাড়িতে শুইয়ে কাজ করতে গেলে চিৎকার করে খুব কাঁদে | শ্রাবনীর মনে কোন খারাপ চিন্তা কখনোই আসেনি | তাই সে তার রানুদিকে অনুরোধ করে তার মেয়েকে রাখার | অনিচ্ছা সর্ত্বেও রানু মেয়েটিকে রাখে | সেদিন কিছু না ঘটলেও পরদিন রমেশ আবার ওই দুজনকে নিয়ে তার বস্তির ঘরে আসে | তাদের ঘরে বসিয়ে রেখে নিজের মেয়ে স্মিতাকে নিয়ে আসে | রানু তার কাছে দিতে অস্বীকার করলে বলে,
" একটু পরেই দিয়ে যাচ্ছি |" রানুর সন্দেহ হয় | সে বস্তির কয়েকজনকে ডেকে এনে কাছাকাছি এদিকে ওদিকে দাঁড়িয়ে থাকতে বলে সজাগ হয়ে | কিছুক্ষন পরে স্মিতাকে তোয়ালে মুড়িয়ে রমেশ নিজেই রাস্তার দিকে হাঁটতে থাকে | একটু দূরে দূরে মহিলা ও পুরুষটি | বস্তির লোকগুলিও ওদের অনুসরণ করে | কিছুদূর গিয়ে তারা দেখে একটি গাড়ি দাঁড়ানো | প্রথমে মহিলাটি গাড়িতে ওঠে পরে রমেশ বাচ্চাটিকে যখন তার কোলে দিতে যায় তখনই বস্তির লোকগুলি হৈহৈ করে পরে রমেশের উপরে চড়াও হয় | রানু ছুটে গিয়ে বাচ্চাটিকে তার নিজের কোলে তুলে নেয় | সুযোগ বুঝে ড্রাইভার গাড়ি চালিয়ে দেয় | কোনক্রমে চলন্ত গাড়ির বাইরে থাকা লোকটি উঠে পরে | সকলে রমেশকে নিয়ে এতো ব্যস্ত ছিল ওই লোকটির কথা সেই মুহূর্তে কারোই মাথায় আসেনি | সেদিন রমেশ বস্তির লোকগুলির কাছে খুব মার খায় কিন্তু তার মুখ থেকে একটি কথাও কেউ বের করতে পারেনা | সন্ধ্যায় ঘরে ফিরে শ্রাবনী সব শুনে তার আর বুঝতে বাকি থাকেনা যে রমেশ তার মেয়েকে টাকার লোভে বিক্রি করে দিতে চেয়েছিলো | সে তার রানুদিকে অনুরোধ করে মেয়েটিকে আর কিছুক্ষণের জন্য রাখতে | ঝড়ের গতিতে সে নিজের ঘরে ফিরে এসে দেখে কানে হেডফোন দিয়ে চোখ বুজে সে মোবাইলে গান শুনছে | সে তার বঁটিটা হাতে তুলে নিয়ে এলোপাথাড়ি কোপ মারতে থাকে রমেশের উপর | এমনিতেই সকালে মার খেয়ে রমেশ কিছুটা নিস্তেজ হয়েছিল তারউপর শ্রাবনীর এই হঠাৎ হামলায় সে বাধা দেওয়ার বিন্দুমাত্র সুযোগ পাইনি | সারা ঘর , বিছানা রক্তে ভেসে যাচ্ছে | রমেশের কোন সারা নেই কিন্তু পাগলের মত শ্রাবনী তার শরীরে একের পর এক কোপ মেরেই চলেছে আর চিৎকার করে বলে চলেছে ,
--- এতদিন ধরে সব অত্যাচার আমি সহ্য করেছি আমার যাওয়ার কোন জায়গা নেই বলে কিন্তু আজ তুই আমার মেয়ের দিকে হাত বাড়িয়েছিস আমি তোকে আর বাঁচতে দেবোনা |
ইতিমধ্যে ঘরে লোক জড়ো হয়ে গেছে | একজন গিয়ে শ্রাবনীর হাত থেকে জোর করে বঁটিটা কেড়ে নেয় | শ্রাবনী মেঝেতে বসে পড়ে | কিছুক্ষন পরে সে মেঝেতেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায় | যখন তার জ্ঞান ফেরে চোখদুটি জবাফুলের মত লাল ঘোলাটে দৃষ্টি | শুধু একটি কথায় বলে চলেছে " বেশ করেছি |" পুলিশ যা জানতে চাইছে উত্তর -" বেশ করেছি "| পুলিশ যখন তাকে নিয়ে যাচ্ছে তার রানুদি এসে তার কোলে স্মিতাকে দিতে গেলে সে ভয়ে আতঙ্কে দুপা পিছিয়ে গিয়ে নিজের হাতদুটির করতলের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে | পুলিশ তাকে নিয়ে চলে যায় | সাতদিন পরে রানু লোক মারফত জানতে পারে শ্রাবনীর ঠাঁই হয়েছে পাগলাগারদে |
No comments:
Post a Comment