ডাইরীর পাতা
একাত্তর সালের পূর্ববাংলার দাঙ্গার সময় আমাকে কোলে নিয়ে বাবা মা যখন গ্রামের এক বাড়ি থেকে অন্য বাড়িতে দু এক রাত আশ্রয় নেন তখন আর একজনের আশ্রয়স্থলও হয় ওই বাড়িগুলি | সে হল আমার রেশমিদিদির | পশ্চিম পাকিস্তানের মিলিটারির আক্রমনে যখন আমাদের গ্রামের হাজার হাজার ঘরবাড়ি পুড়িয়ে ছাই করে দিচ্ছে , নিরীহ মানুষগুলিকে বিনা কারনে গুলি করে মারছে -- | তাদেরই শিকার হয়েছিল রেশমিদিদিদের পরিবার | রেশমির বাবা দিনমজুর আনোয়ার হোসেন | পুরো গ্রাম যখন গেরিলাবাহিনীর হাতের মুঠোই চলে আসে ঠিক তখন আনোয়ার চাচা নারকেল গাছে উঠে নারকেল পাড়ছিলেন | মিলিটারিরা তাকে দিয়ে ডাব পাড়িয়ে খেয়ে নিয়ে তাকেই গুলি করে মারে | দূর থেকে গুলি করে খড়ের ছাউনি দেওয়া বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয় | চাচি আর দুই ছেলেমেয়ে ঘরের ভিতর আগুনে পুড়ে মারা যান | রেশমিদিদির বয়স তখন পাঁচ কি ছবছর | সে তখন বাগানে গেছিলো শাকপাতা কুড়াতে দুপুরে ভাতের সাথে খাওয়া হবে বলে | বাড়িতে এসে দেখে দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে | ভয়ে আতঙ্কে অজ্ঞান হয়ে পরে যায় | বাবা মায়ের কাছে গল্প শুনেছি ওই আক্রমনের সময় বাবা আর মা আমাকে নিয়ে বাড়িরই এক জঙ্গলে আশ্রয় নিয়েছিলেন | জঙ্গলে বসেই দেখতে পান পাশে আনোয়ার চাচার বাড়ি দাউ দাউ করে জ্বলছে | কিন্তু বেরিয়ে আসার সাহস দেখাতে পারেননি | সন্ধ্যার পর অন্ধকার নেমে এলে আমাকে কোলে করে বাবা ও মা জঙ্গল থেকে বেরিয়ে আসেন | আমাকে ও মাকে কয়েকটা বাড়ির পর গফুর চাচাদের বাড়িতে রেখে বাবা যান আনোয়ার চাচার খোঁজে | কয়েকজন গ্রামের লোকের কাছেই জানতে পারেন পুকুরপাড়ে নারকেল গাছের তলায় আনোয়ার চাচার মৃতদেহ পরে আছে | এইরূপ এখানে ওখানে প্রচুর মৃতদেহ পরে থাকায় গ্রামের কিছু লোক মিলে কিছু দেহের সৎকার করা যদিও সম্ভব হয় বাকি দেহগুলি শেয়াল কুকুরের ছিড়ে খায় | আনোয়ার চাচার বাড়ির দোরগোড়ায় এসে যখন সকলে জমা হলেন বড় টর্চের আলোতে দেখতে পেলেন শুধু ছাই আর ছাই | হঠাৎই তারা শুনতে পান একটি বাচ্চার কাতর কান্নার আওয়াজ | সকলে সেদিকেই ছোটেন | রেশমিদিদিকে পাড়ার অন্য কেউ রাখতে তেমন আগ্রহ প্রকাশ না করাতে বাবা ই তাকে কোলে করে তুলে নিয়ে মায়ের কোলে এনে বসিয়ে দিয়ে বলেন ,
-- মেয়েটি তার জীবনের সব খুঁইয়েছে| এই পৃথিবীতে আপন বলতে ওর আর কেউ নেই | আজ থেকে আমাদের দুটি মেয়ে |
মা ও দুহাতে রেশমিদিদিকে বুকের সাথে চেপে ধরেন আর বাবাকে বলেন ,
--- হ্যাগো এখন কি হবে? কোথায় থাকবো? কি খাবো ?
--- চিন্তা কোরোনা ভোরের আলো ফুটুক সকলের যা হবে আমাদেরও তাই হবে | গফুর তো বলেছে যে কটাদিন খুশি ওর বাড়ি আমরা থাকতে পারবো |
আমার বাবা ছিলেন একজন ডাক্তার | বহু দূরদূরান্ত থেকে আরোগ্য লাভের আশায় বারবার লোকে ছুটে আসতো | গ্রামের অধিকাংশ গরীব মানুষই ছিল বিনা পয়সার রোগী | তাদের চিকিৎসা করে ওষুধ কেনার টাকা দিতেও কখনো বাবা কুন্ঠাবোধ করেননি | আর অন্দরমহলে মা ছিলেন দেবী অন্নপূর্ণা | দরিদ্র মানুষ চিকিৎসার জন্য এলেই পেট ভরে ভাত তারা খেতে পারবে এ তারা জেনেই আসতো | দেশের এই চরম দুর্দিনের সময় সেই সব মনে রেখেই হয়তো ঈশ্বরের দূত হিসাবে অনেক মানুষের কাছ থেকেই উপকার আমরা পেয়েছি | গফুর চাচার বাড়িতে দিন পনের থাকার পর বাবার এক পেসেন্ট একদিন রাতেরবেলা এসে হাজির | তিনি আমাদের নিয়ে যেতে চান তার বাড়ি মোল্লাহাট থানার অন্তগত গাওলায় | সেখানে নাকি পাকিস্তানী বাহিনীর কোন উপদ্রব নেই | আছে দেশকে পরাধীনতার শৃংখল থেকে মুক্ত করার জন্য সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধা বাহিনী | আর সেখানে আমার বাবা অপরেশ ব্যানার্জির কাজ হচ্ছে আহত মুক্তিযোদ্ধা বাহিনীর সেবা করা | বাবা এককথায় রাজি হয়ে গেলেন | এ কটাদিন বাবা চুল দাঁড়ি না কাটার কারনে সেগুলো বেশ বড় হয়ে গেছিলো | গ্রামে গ্রামে শুরু হয়েছে তখন দেশের খেয়ে দেশের পরে রাজাকার বাহিনীর উপদ্রব | তারা তখন বুদ্ধিজীবীদের ধরে ধরে হত্যালীলার মেতেছে | গ্রামের " মোস্ট ওয়ান্টেড পার্সন " এর মধ্যে বাবার নাম দ্বিতীয় নম্বরে | বাবার ওই চুল ও দাঁড়ি বাবাকে বাঁচতে সাহায্য করেছে | বাবাও তখন প্রতিজ্ঞা করলেন দেশ স্বাধীন না হলে তিনি তার চুল ও দাঁড়ি কাটবেননা |
রাতেরবেলা নৌকা করে আমাদের নিয়ে নৌকার মাঝি হয়ে দাঁড় টেনে বাবা পৌঁছালেন গাওলায় |
বাবা যখন তখন বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়তেন যে কারো ডাকে | মায়ের কাছে গল্প শুনেছি সকালবেলা ঘুম থেকে উঠলেই কেউ মাছ কেউবা আনাজপাতি নিয়ে আমাদের দোরগোড়ায় হাজির হয়ে যেতেন | কোন কষ্ট ঐসময় আমরা পাইনি | দেশ স্বাধীন হওয়ার ঠিক সপ্তাহখানেক আগে বাবা অন্যান্য লোকজনের সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের শিবির থেকে তাদের চিকিৎসা দিয়ে ফিরছিলেন তখন বিষধর সাপের কামড়ে বাবা মারা যান | বড় হয়ে মায়ের কাছে শুনেছি বাবা মৃত্যুর আগে মায়ের হাত ধরে বলে গেছিলেন " সবসময় মনে রেখো আমাদের কিন্তু দুই মেয়ে | রেশমির বাবা আমি আর মা তুমি - সারা পৃথিবী যেন এটাই জানে | দেশ একদিন স্বাধীন হবেই | মেয়েদুটিকে যথেষ্ট শিক্ষায় শিক্ষিত কোরো তাহলেই আমার আত্মা শান্তি পাবে |"
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মা আমাকে ও রেশমিদিদিকে নিয়ে গ্রামের বাড়ি আসেন | কিন্তু জাতপাতের বিচারে হিন্দু ব্রাহ্মণ ঘরে মুসলমান ঘরের মেয়েকে নিয়ে একসাথে খাওয়াবসা গ্রামের লোকজন ঠিক ভালোভাবে মেনে নিলোনা | মা জলের দামে জমিজমা , বাড়িঘর সব বিক্রি করে গফুরচাচার সাহায্যে অজানা এক শহরে এসে ঘর ভাড়া নিয়ে থাকতে শুরু করলেন | রেশমিদিদিকে স্কুলে ভর্তি করলেন | রেশমি ব্যানার্জি বাবা অপরেশ ব্যানার্জি | যথা সময়মত আমিও স্কুলে ভর্তি হলাম | দিদি আমার থেকে তিন বছরের বড় | মা সারাটাদিন লোকের কাঁথা সেলাই করে , ছোটছোট বাচ্চাদের পড়িয়ে টাকা রোজগার করার চেষ্টা করতেন | জমিজমা বিক্রির টাকা না পারতে মা তুলতেননা | ওটা আমাদের দুবোনের উচচশিক্ষার্থের জন্য গচ্ছিত ছিল | দিদি ছিল অসাধারণ মেধাবী | সে তার মেধাশক্তির পরিচয় দিয়ে ডাক্তারিতে সুযোগ পেয়ে গেলো | মা ভীষণ খুশি হলেন | আমাদের ডেকে বললেন , " আজ তোদের বাবা বেঁচে থাকলে খুব খুশি হতেন |" মা আমাদের দুজনকে জড়িয়ে ধরে খুব কাঁদলেন |
পাঁচ বছরের শিশুর জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনা স্বপের মতোই আবছা হয়ে যায় | আমার রেশমিদিদিও তার ব্যতিক্রম নয় | সেও ভুলে গেছে তার জীবনের অতীত | পড়াশুনায় আমি ছিলাম মধ্যমমানের | উচ্চশিক্ষা নেওয়ার মত ব্রেন আমার নয় | মা চেষ্টা করেছিলেন এবং এও বুঝেছিলেন আমার দ্বারা তা সম্ভব নয় | ঘষেমেজে গ্রাজুয়েশনটা করলাম |মায়ের বয়স হয়েছে দুই দুটি যুবতী মেয়ে | তাদের বিয়ে থা দিতে হবে দিদি নিজের পায়ে না দাঁড়িয়ে বিয়ে করবেনা অতএব ' মা তুমি আগে বোনের বিয়ে দাও |' শুরু হল আমার জন্য ছেলে দেখা | সুন্দরী বলতে যা বোঝায় তা আমি কোনদিনও ছিলামনা | আমার বিয়ের জন্য ছেলে পেতে প্রায় দুবছর লেগে গেলো মায়ের | দিদিরও ডাক্তারী পড়া শেষ | সাংসারিক পরিস্থিতিরও কিছুটা উন্নতি হয়েছে ততদিনে | কারন আমরা দুবোন মিলে বাড়িতেই একটা কচিনসেন্টার খুলে বেশ কিছু ছেলেমেয়েদের পড়ানোর ব্যবস্থা করেছি |
আমার বিয়ের মাত্র পনেরদিন বাকি | মা ও দিদির দম ফেলার ফুসরৎ নেই | মাঝে মাঝে দিদির নাইট ডিউটি থাকে | বাড়িতে এসে মাকে সাহায্য করে বেশি আর ঘুমায় কম | একদিন হাসপাতাল থেকে ফিরে দিদি দুপরে ঘরে বিশ্রাম নিচ্ছে আমি মায়ের হাতে হাতে কাজ করছি হঠাৎ দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে আমার আগেই মা উঠে দরজা খুলতে যান আর ঠিক তখনই মেঝেতে রাখা সুটকেসে বেঁধে মা পরে গিয়ে গোড়ালির হাড় ভেঙ্গে যায় |
অপারেশন করে বন্ডে দিদি সই করে বিয়ের দুদিন আগে মাকে হাসপাতাল থেকে দিদি বাড়ি নিয়ে আসে | একা হাতে সমস্ত কর্তব্যকর্ম করে চলে | কিন্তু সমস্যা বাধে সম্প্রদানের সময় | কথা ছিল মা সম্প্রদান করবেন | কিন্তু এই অবস্থায় মায়ের নিচুতে বসা একদম বারণ| দিদি গিয়ে মায়ের কাছে অনুমতি চাইলো আমাকে সম্প্রদান করার জন্য | মা দিদিকে বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে অনুমতি দিলেন | পরেরদিন আমি শ্বশুরবাড়ি চলে আসি |
মায়ের শত অনুরোধ সর্ত্বেও দিদি বিয়েতে রাজি হয়না | দিদির বক্তব্য সে চলে গেলে তার মাকে কে দেখবে ? আমার বিয়ের পাঁচবছর পর মা ও একদিন ঘুমের মধ্যেই চলে যান | সেদিন মা খাওয়াদাওয়ার পর খাটে শুয়ে দিদিকে ডেকে বলেন ," মা রেশম ( এই নামেই মা দিদিকে ডাকতেন ) আমাকে একগ্লাস জল দেতো" দিদি মায়ের হাতে জলটা দিয়ে বলে ," মা তুমি তো এই সময় কখনোই জল খাওনা আর খেলেও নিজে উঠে গিয়ে খাও | তবে কি তোমার শরীর খারাপ করছে আমায় বলো মা |" মা দিদির কথায় হেসে পরে বলেন , " ওরে আমার শরীর খারাপ লাগলে তোকে তো সকলের আগেই জানাবো | তুই তো আমার ডাক্তার মেয়ে | আমার গর্ব আমার অহংকার |"
কিন্তু মা দিদিকে তার শরীর খারাপের কথা জানানোর আর সুযোগই পেলেননা | দিদিও মায়ের পাশে থেকে কিচ্ছুটি টের পেলোনা |
দিদি সম্পূর্ণ একা হয়ে পরে | ওই বাড়িতে বাস করা তার পক্ষে অসম্ভব হয়ে পরে | সারাটা জায়গায় মায়ের স্মৃতি ছড়ানো | সে সিদ্ধান্ত নেয় অন্য কোথাও ট্রান্সফার নিয়ে চলে যাবে | এই পাঁচ বছরে ডাক্তার হিসাবে দিদির খুব নামডাক হওয়ায় সে তার পছন্দমত জায়গায় ট্রান্সফার লেটার পেয়ে যায় | আমায় চিঠি দিয়ে সবকিছু জানায় |
একদিন সন্ধ্যায় মেয়ে তার ঘরে বসে পড়ছে ওর বাবা তখনও অফিস থেকে ফেরেনি হঠাৎ কলিংবেলটা বেজে ওঠে | খুলে দেখি দিদি দাঁড়িয়ে | আমি তো দুই হাতে দিদিকে ঝাপটে ধরে বকবক করেই চলেছি কিন্তু দিদি অদ্ভুতভাবে নীরব |
--- দিদি তুই ঠিক আছিস তো ? তুই এতো চুপচাপ কেন রে ?
দিদি কোন উত্তর না দিয়ে ব্যাগ থেকে একটা পুরনো ডাইরী বের করে আমার হাতে ধরিয়ে দেয় আর বলে ,
--- বাবার ডাইরী , মায়ের আলমারির মধ্যে ছিলো | বাবা এই ডাইরীতে যা লিখে গেছেন তা সব সত্যি রে বোন | আমি তোদের কেউনা | তোদের পাশের বাড়ির অতি দরিদ্র এক মুসলমান পরিবারের মেয়ে |
দিদি হাউ হাউ করে কাঁদছে | আমি তাড়াতাড়ি দিদির মার্ক করা পাতাগুলো দম বন্ধ করে এক নিঃশ্বাসে পড়ে পুরো থ হয়ে যাই | দিদির কান্না দেখে দিদিকে জোরে বুকের সাথে চেপে ধরে বলি ,
-- বাবা মৃত্যুর সময় মাকে যে কথা বলেছিলেন মা তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছেন | এতদিন পর্যন্ত মা ছাড়া আর কেউই জানতো না আমরা আপন সহোদরা নই | আজ যখন আমরা দুজনে জেনেই গেছি আয় দিদি দুজনে বাবা মায়ের নামে শপথ করি একথা পৃথিবীর আর কেউই জানবেনা | আমরা এই ডাইরী আজই পুড়িয়ে ফেলবো দুজনে মিলে | তুইই তো বাবার যোগ্য সন্তান | আমাদের বাবা ডাক্তার ছিলেন তুইও ডাক্তার হয়েছিস | আর বড় দিদি হয়ে আমায় সম্প্রদান করে বাবার মত কাজ করেছিস | মা মৃত্যুর আগে তোর কাছ থেকে জল চেয়ে খেয়েছেন | এর পরেও বলবি তুই আমার রক্তের সম্পর্কের কেউ নয় ?আমাদের দুই বোনকে মা কোনদিনও ভালোবাসায় কখনো কার্পণ্য করেননি বা আলাদা চোখে দেখেননি | আমার তো মনে হয় মা তোকে আমার থেকে একটু বেশি ভালোবাসতেন | ওই যে তুই ছিলি লেখাপড়ায় সেরা |
এতক্ষণ রেশমি কেঁদেই চলেছিল | এবার হেসে দিয়ে বললো ,
-- হিংসুটে কোথাকার |
--- চল দিদি আজই এক্ষুনি ছন্দার বাবা অফিস থেকে ফেরার আগেই আমাদের অভিশপ্ত অতীতের এই ডাইরী আমরা পুড়িয়ে ফেলি |
দুইবোনে ডাইরী আর একটা দেয়াশলাই নিয়ে ছাদের সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেলো |
No comments:
Post a Comment