প্রেমের ফাঁদ
নন্দা মুখাৰ্জী রায় চৌধুরী
রাগে গজগজ করতে করতে সৈরিতি শাড়ির কুচিটা ধরে হনহন করে কলেজ চত্বর ছেড়ে বেরিয়ে আসলো | বছরে একবার কি দুবার শাড়ি পরে তারমধ্যে এই সরস্বতী পূজার দিন মাস্ট | রাহুলের সাথে বন্ধুত্ব হওয়ার পর এটা সৈরিতির প্রথম সরস্বতী পুজো | কলেজে ঢুকে এদিকে ওদিকে তাকিয়ে রাহুলকে দেখতে না পেয়ে পুজোর জন্য বরাদ্ধ হলরুমটাই ঢুকে দেখে রাহুল খুব ঘনিষ্ঠভাবে অদৃতার সাথে সেলফি তুলছে | দেখেই মাথাটা গরম হয়ে যায় ওর | সঙ্গে সঙ্গেই সেখান থেকে ও বেরিয়ে আসে |
বন্ধু স্বাতী ওকে দেখতে পেয়ে বলে ওঠে ,
-- আরে তুই তো আজকের জ্যান্ত সরস্বতী রে -- হলুদ শাড়ি আর সবুজ ব্লাউজে তোকে পুরো মা সরস্বতীর মত লাগছে |
স্বাতীর কথা শুনে একটু মুচকি হেসে দিলো সৈরিতি | অথচ এই কথাটা রাহুল বললে তার আরও বেশি কেন যে ভালো লাগতো সে আজও তা বুঝে উঠতে পারলোনা | নিজেকে নিজে বহুবার সে প্রশ্ন করেছে -- " তবে কি রাহুলকে আমি ভালোবাসি ?" কিন্তু পরক্ষনে নিজের মনেই হেসে নিজেই জবাব খুঁজে নিয়েছে -" দূর না না , রাহুল শুধুই আমার বন্ধু |"
একটু পরে দাঁত বের করে রাহুল হাসতে হাসতে সৈরিতির সামনে দাঁড়িয়ে বলে ,
--- বাব্বা - সরস্বতী পুজোতে এতো সেজেছিস তাহলে তোর বিয়ের দিনে তুই কত সাজবি ?
--- সে তোকে ভাবতে হবেনা , আমার বিয়েতে তোকে নিমন্ত্রণও করবোনা | যা তুই গিয়ে সেলফি তোল |
রাহুল বুঝতে পারে সৈরিতির সাথে ছবি তুলতে দেখেই ওর রাগ হয়েছে | ওর বলা কথাটাকে পাত্তা না দিয়েই বলে ,
--- তোর বিয়ের সাজ তো আমিই দেখবো - যাকগে সেকথা , দেখ দেখ অদৃতার সাথে ছবিগুলো কত সুন্দর উঠেছে | আসলে ওকে আজকে দেখতে ভীষণ সুন্দর লাগছে | ( কথাগুলো বলেই মিটিমিটি হাসতে লাগে )
রাগে অভিমানে সৈরিতি তখন ঠকঠক করে কাঁপছে |
--- তা এখানে এসেছিস কেন ?যা ওর কাছে যা -- বলেই হনহন করে সেখান থেকে চলে গেলো |
অঞ্জলি দেওয়ার সময় রাহুল এসে সৈরিতির ঠিক পাশে এসে বসলো | সৈরিতিতো রাহুলের দিকে ফিরেও তাকালো না | ঠাকুরমশাই শান্তির জল যখন দিচ্ছেন রাহুল চিৎকার করে বলে উঠলো ,
--- ঠাকুরমশাই , এদিকে একটু বেশি শান্তির জল দেবেন মাথাটা ঠান্ডা হওয়ার জন্য |
সৈরিতি কটমট করে রাহুলের দিকে তাকালো | রাহুল খুব গম্ভীরভাবে বললো , " তোর কথা বলিনি |"
পিছন দিকে ফিরে ফিক করে হেসে দিলো রাহুল যা সৈরিতির নজর এড়ালোনা | অঞ্জলি দেওয়া শেষ হয়ে গেলে সৈরিতি সঙ্গে সঙ্গে কলেজ থেকে বেরিয়ে পরে | কলেজ থেকে ওর বাড়ি হাঁটা রাস্তা | বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় মাকে বলে গেছিলো ফিরতে দেরি হবে | তাড়াতাড়ি ফিরে আসাতে মা জানতে চাইলেন ,
--- কিরে এতো তাড়াতাড়ি ফিরে আসলি বললি যে ফিরতে দেরি হবে | তাহলে তো নিশ্চয়ই খেয়েদেয়ে আসিসনি -- কাপড়জামা ছেড়ে আয় একসাথেই খাই | আমারও খাওয়া হয়নি এখনো |
--- মা আমি খেয়ে এসেছি | শরীরটা ভালো লাগছিলোনা তাই চলে এলাম | তুমি খেয়ে নাও | আমি একটু ঘুমাবো আমায় ডেকোনা |
ঘরে ঢুকে সেই পোশাক পরেই সে খাটের উপর শুয়ে পড়লো | কি এমন হল যে তার চোখ থেকে জল পড়েই চলেছে --- তা সে নিজেও বুঝতে পারছেনা | নিজেকে নিজে প্রশ্ন করে , " আচ্ছা কেন রাহুলের সঙ্গ আমার এতো ভালো লাগে ? কেন রাহুল অন্য মেয়েদের সাথে সময় কাটালে আমার এতো রাগ হয় ? রাহুলের মুখ থেকে প্রশংসা শুনতে কেন আমার এতো ভালো লাগে ? রাহুল অন্য মেয়েদের প্রশংসা করলে কেন তার প্রতি এতো হিংসা হয় ?---- হঠাৎ দরজায় কড়া নাড়ানোর শব্দ | মনেমনে রাগ হয় সৈরিতার এতো করে মাকে বললাম যেন বিরক্ত না করে ঠিক আবার খাওয়ার জন্য ডাকতে এসেছেন |
দরজা খুলে দেখে রাহুল দাঁড়িয়ে হাতে খাবারের প্যাকেট |
--- তুই এখন কেন এসেছিস ? তোর অদৃতা তোকে ছাড়লো ?
--- সর সর -- ভিতরে ঢুকতে দে --| খুব তো রাগ দেখিয়ে না খেয়ে দুমদাম পা ফেলে চলে আসলি -- |
--- আমি খাই কি না খাই তাতে তোর কি ?
--- সেটা যদি বুঝতিস তাহলে তো হয়েই যেত | খুব খিদে পেয়েছে রে --- আর কথা বাড়াসনা , চল দুজনে খেয়ে নি --|
--- তুই কেন খাসনি ?
--- নিজেকে প্রশ্ন কর উত্তর পেয়ে যাবি |
সৈরিতির মা ঘরে ঢুকে দুটো প্লেট দিয়ে গেলেন | কারন রাহুল সৈরিতিদের বাড়িতে এসে প্রথমেই ওর মায়ের সাথে দেখা করে বলেছে সৈরিতি রাগ করে না খেয়ে অঞ্জলি দিয়েই চলে এসেছে | তাই দুজনের খাবারটা নিয়ে সে চলে এসেছে | রাহুলকে খুব স্নেহ করেন তিনি | মাঝে মধ্যেই সে এ বাড়িতে আসে | দুজনের মধ্যে যে একটা সম্পর্ক তৈরী হয়েছে তা তিনি খুব বুঝতে পারেন | এই ব্যাপারে তার কোন আপত্তিও নেই | দেখতে সুন্দর , স্বভাবচরিত্র ভালো , বড়লোকের ছেলে -- সুতরাং আপত্তি করার কোন প্রশ্নই ওঠেনা |
রাহুল খেতে খেতে বলে ,
--- তোকে একটা কথা বলা হয়নি --
--- কি কথা ?
--- আজকে তোকে খুব সুন্দর লাগছিলো দেখতে |
--- সেটা এখন মনে হল ?
--- না তা কেন ? সব কথা সবসময় কি বলা যায় ?
--- ও আমার কথা বলা যায়না অদৃতির কথা বলা যায় |
--- সারাজীবন মাথামোটাই থেকে গেলি রে -- | মা সরস্বতীকে অনেক বলেছি তোকে যেন একটু বুদ্ধি দেন |
রাহুল কথাটা বলেই সৈরিতির মাথাটা ধরে আলতো সরিয়ে দেয় |
কলেজে আর মাত্র কয়েকটা মাস | তার পরেই যে যার ভুবনে | কত পরিচিত , কাছের বন্ধু কতজনের সাথেই হয়তোবা আর জীবনেও দেখা হবেনা | যার যার জীবনে কেউবা প্রতিষ্ঠিত আর কেউবা আজীবন জীবনযুদ্ধের লড়াইয়ে হেরো হয়েই কাটিয়ে দেবে | স্কুল জীবনের অনেক বন্ধুই হারিয়ে গেছে কলেজ জীবনে | রাস্তাঘাটে কারো সাথে মাঝেমধ্যে দেখা হয় আর কেউবা স্কুলছুটের পর অদেখাই থেকে গেছে |
রাহুল সৈরিতিকে প্রচন্ড ভালোবাসে | রাহুল বুঝতে পারে সেও তাকে ভালোবাসে | কিন্তু সৈরিতি নিজের মনের কথা নিজেই বুঝতে পারেনা | ফাইনাল ইয়ারে ফাইনাল পরীক্ষার শেষ কলেজের দিন বন্ধুদের সাথে পরামর্শ করে একটা প্লান করে রাহুল | সৈরিতি কলেজে আসলে রাহুল মুখ কালো করে বলে ,
--- তোর সাথে একটা কথা আছে -
--- এখনই বলবি --- তাড়াতাড়ি বল , আমার কাজ আছে -
--- একটু ওদিকে চল
-- কত ঢং যে তুই জানিস চল কোথায় যাবি ?
কিছুটা এগিয়ে এসে একটু নির্জন জায়গায় দাঁড়িয়ে বললো ,
--- এখানে বলা যাবে তো ?
--- হ্যাঁ
রাহুল মাথা চুলকে একটু গম্ভীর হয়ে বললো ,
-- আমার বাবা কলকাতা থেকে ট্রান্সফার হয়ে গেছেন --
--- তো ? আমি কি করবো ?
রাহুল কৃত্রিম রাগ দেখিয়ে বললো ,
--- যা শুনতে হবেনা তোর , তোর তাড়া আছে তুই চলে যা -
রাহুল পা বাড়ায় , পিছন থেকে সৈরিতি তার হাত টেনে ধরে বলে ,
--- বাব্বা আজ যে একদম রেগে ফায়ার হয়ে আছিস | আচ্ছা শুনছি বল |
--- আগামী সপ্তাহেই আমাদের শিলিগুড়ি চলে যেতে হবে | পরীক্ষার সময় এসে মাসির বাড়ি থেকে পরীক্ষা দেবো |
--- বুঝলুম তা আমাকে কি করতে হবে ?
রাহুলের ইচ্ছা করছে তখন সৈরিতির মাথাটা ধরে কোন দেওয়ালে ঠুকে দেয় | তবুও দাঁতে দাঁত চেপে বললো ,
--- তোর সাথে আর আমার দেখা হবেনা |
--- ও এই কথা | নাহলে আর কি করা যাবে | চল আজ একটু ফুচকা খাওয়া আমায় |
রাহুলের সর্বশরীর রাগে তখন জ্বলে যাচ্ছে | তবুও মুখে হাসি এনে বললো ,
--- চল তাহলে | অদৃতাকে ডেকে নিই ওউ বলছিলো ফুচকা খাবে |
--- আমি খাবোনা , তুই বরং ওকেই খাওয়া আফটারঅল ও তো তোর খুব কাছের ---
রাগ করে সৈরিতি চলে এলো | কিন্তু চলে তো এলো মনটা ওর ভীষণ খারাপ হয়ে গেলো | কিছুতেই বুঝতে পারছেনা কেন এরকম লাগছে | তবে কি রাহুলের সাথে আর দেখা হবেনা বলেই কি ওর এরকম লাগছে | কিন্তু রাহুল তো শুধু বন্ধু | বাড়ির পথে হাঁটতে হাঁটতে নিজের সাথে নিজেই কথা বলতে থাকে সৈরিতা | রাহুলের সাথে আর দেখা হবেনা ভাবলেই চোখ থেকে জল পড়ে যাচ্ছে | "তবে কি এটাকেই ভালোবাসা বলে ? আমি রাহুলকে তাহলে ভালোবাসি? এইজন্যই ওর সাথে অন্যকোন মেয়েকে দেখলে আমার রাগ হয় ?রাহুল চলে যাওয়ার আগেই ওকে আমার বলতে হবে ওকে আমি ভালোবাসি ?" আবার কলেজে ফিরে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায় | রাহুলকে ফোন করে | কিন্তু ফোন বেজে যায় রাহুল ধরেনা | এবার আর ওর রাগ হয়না | খুব কষ্ট হয় | নিশ্চয় অদৃতার সাথে গল্প করছে | তিন চারবার ফোন করার পর রাহুল ধরে মিথ্যা বলে ,
--- আরে অদৃতা আর আমি ফুচকা খাচ্ছিলাম | বল কি হয়েছে ?
--- তুই কোথায় ?
--- কলেজের সামনে রাস্তায় --
--- দাঁড়া আমি আসছি --
আসলে রাহুল তখন কলেজের মাঠে বসে ওর বন্ধুদের কাছ থেকে সৈরিতির মুখ থেকে কিভাবে কথা বের করা যায় তার পাঠ নিচ্ছিলো | সে সৈরিতিকে পুনরায় ফোন করে ওখানেই আসতে বলে | সৈরিতি ঘেমে নেয়ে একসার হয়ে হন্তদন্ত হয়ে রাহুলের কাছে এসে পৌঁছায় |
--- বল কি বলবি তাড়াতাড়ি বল বাড়িতে অনেক কাজ রয়েছে | মাকে প্যাকিংয়ের ব্যাপারে হেল্প করতে হবে ---
সৈরিতি আস্তে আস্তে রাহুলের একদম কাছে চলে যায় | রাহুল কিছু বোঝার আগেই এদিকে ওদিকে তাকিয়ে আলতো করে রাহুলের ঠোঁঠে চুমু খায় | আর বলে ," ভালোবাসি তোকে |"
--- অবশেষে বুঝলি তাহলে --
মাথা নিচু করে সৈরিতি ঘাড় নেড়ে বলে ,
--- হয়তো কোনদিনও বুঝতে পারতামনা কিন্তু তুই শিলিগুড়ি চলে যাবি শুনে তোর সাথে আর দেখা হবেনা ভেবে আমার ভিতরের কষ্ট আমায় বুঝিয়ে দিয়েছে আমি তোকে ভালোবাসি |
--- কিন্তু আমি তো কোথাও যাচ্ছিনা
--- মানে ?
অদৃতা সহ আরো কিছু বন্ধুরা তখন ঝোপঝাড় আর গাছের আড়াল থেকে হৈহৈ করে বেরিয়ে এসে সকলে চিৎকার করে বললো ,
-- আরে গর্দভ এটা তোর মুখ থেকে কথা বের করার জন্য অদৃতি এই বুদ্ধিটা দিয়েছিলো |
প্রথমে লজ্জায় লাল হয়ে গেলো সৈরিতি নিজের মনে নিজেই ছোট হয়ে গেলো অদৃতিকে নিয়ে রাহুলকে নানান কথা শুনানোর জন্য -- যখন সে নিজের মনে নানান ভাবনায় ব্যস্ত তখন বন্ধুদের উর্দ্যেশ্যে রাহুল বলে উঠলো ,
-- বুঝতে পারছিস তোরা আমার ভবিৎষত এই মাথা মোটাটাকে নিয়ে আমায় সারাজীবন কাটাতে হবে --
সঙ্গে সঙ্গে সৈরিতা নিজ মূর্তি ধারণ করলো
-- শয়তান একটা , মিথ্যেবাদী আমাকে কষ্ট দেওয়ায় শুধু তোর উর্দ্যেশ্য ---
সৈরিতির কান্ড দেখে সবাই হোহো করে হাসতে লাগলো |
---