Friday, February 14, 2020

প্রেমের ফাঁদ



   প্রেমের  ফাঁদ  

    নন্দা  মুখাৰ্জী  রায়  চৌধুরী  

  
   রাগে গজগজ  করতে  করতে  সৈরিতি শাড়ির  কুচিটা  ধরে  হনহন  করে  কলেজ  চত্বর  ছেড়ে  বেরিয়ে  আসলো | বছরে  একবার  কি  দুবার  শাড়ি  পরে  তারমধ্যে  এই  সরস্বতী  পূজার  দিন  মাস্ট | রাহুলের  সাথে  বন্ধুত্ব  হওয়ার  পর  এটা সৈরিতির প্রথম  সরস্বতী  পুজো  | কলেজে  ঢুকে  এদিকে  ওদিকে  তাকিয়ে  রাহুলকে  দেখতে  না  পেয়ে  পুজোর  জন্য  বরাদ্ধ  হলরুমটাই  ঢুকে  দেখে  রাহুল খুব  ঘনিষ্ঠভাবে  অদৃতার সাথে  সেলফি  তুলছে  | দেখেই  মাথাটা  গরম হয়ে  যায়  ওর  | সঙ্গে  সঙ্গেই  সেখান  থেকে  ও  বেরিয়ে  আসে  | 
 বন্ধু  স্বাতী  ওকে  দেখতে  পেয়ে  বলে  ওঠে  ,
-- আরে তুই  তো  আজকের  জ্যান্ত  সরস্বতী  রে  -- হলুদ  শাড়ি  আর  সবুজ  ব্লাউজে  তোকে  পুরো  মা  সরস্বতীর  মত  লাগছে  |
 স্বাতীর  কথা  শুনে  একটু  মুচকি  হেসে  দিলো  সৈরিতি  | অথচ  এই  কথাটা  রাহুল  বললে  তার  আরও বেশি  কেন  যে  ভালো  লাগতো  সে  আজও তা  বুঝে  উঠতে  পারলোনা  | নিজেকে  নিজে  বহুবার  সে  প্রশ্ন  করেছে  -- " তবে  কি  রাহুলকে  আমি  ভালোবাসি ?" কিন্তু  পরক্ষনে  নিজের  মনেই  হেসে  নিজেই  জবাব  খুঁজে  নিয়েছে  -" দূর  না  না  , রাহুল  শুধুই  আমার  বন্ধু  |" 
  একটু  পরে দাঁত বের  করে রাহুল  হাসতে হাসতে সৈরিতির সামনে  দাঁড়িয়ে  বলে  ,
--- বাব্বা  - সরস্বতী  পুজোতে  এতো  সেজেছিস  তাহলে  তোর  বিয়ের  দিনে  তুই  কত  সাজবি ?
--- সে  তোকে  ভাবতে  হবেনা  , আমার  বিয়েতে  তোকে  নিমন্ত্রণও  করবোনা  | যা  তুই  গিয়ে  সেলফি  তোল |
 রাহুল  বুঝতে  পারে  সৈরিতির সাথে  ছবি  তুলতে  দেখেই  ওর  রাগ  হয়েছে  | ওর  বলা  কথাটাকে  পাত্তা  না  দিয়েই  বলে  ,
--- তোর  বিয়ের  সাজ  তো  আমিই  দেখবো  -  যাকগে  সেকথা  , দেখ  দেখ  অদৃতার সাথে  ছবিগুলো  কত  সুন্দর  উঠেছে  | আসলে  ওকে  আজকে  দেখতে  ভীষণ  সুন্দর  লাগছে  | ( কথাগুলো  বলেই  মিটিমিটি  হাসতে লাগে  )
রাগে অভিমানে  সৈরিতি তখন  ঠকঠক  করে  কাঁপছে  |
--- তা  এখানে  এসেছিস  কেন  ?যা  ওর  কাছে  যা  -- বলেই  হনহন  করে  সেখান  থেকে  চলে  গেলো  |
  অঞ্জলি  দেওয়ার  সময়  রাহুল  এসে  সৈরিতির ঠিক  পাশে  এসে  বসলো  | সৈরিতিতো রাহুলের  দিকে  ফিরেও তাকালো  না  | ঠাকুরমশাই  শান্তির  জল  যখন  দিচ্ছেন  রাহুল  চিৎকার  করে  বলে  উঠলো  ,
--- ঠাকুরমশাই  , এদিকে  একটু  বেশি  শান্তির  জল  দেবেন  মাথাটা  ঠান্ডা  হওয়ার  জন্য  | 
 সৈরিতি কটমট  করে  রাহুলের  দিকে  তাকালো  | রাহুল  খুব  গম্ভীরভাবে  বললো  , " তোর  কথা  বলিনি  |"
 পিছন  দিকে  ফিরে ফিক  করে  হেসে  দিলো  রাহুল  যা  সৈরিতির নজর  এড়ালোনা  | অঞ্জলি  দেওয়া  শেষ  হয়ে  গেলে  সৈরিতি সঙ্গে  সঙ্গে  কলেজ  থেকে  বেরিয়ে  পরে  | কলেজ  থেকে  ওর  বাড়ি  হাঁটা রাস্তা  | বাড়ি  থেকে  বেরোনোর  সময়  মাকে বলে  গেছিলো  ফিরতে  দেরি  হবে  | তাড়াতাড়ি  ফিরে  আসাতে মা  জানতে  চাইলেন  ,
--- কিরে  এতো  তাড়াতাড়ি  ফিরে  আসলি  বললি যে  ফিরতে  দেরি  হবে  | তাহলে  তো  নিশ্চয়ই  খেয়েদেয়ে  আসিসনি  -- কাপড়জামা  ছেড়ে  আয় একসাথেই  খাই  | আমারও  খাওয়া  হয়নি  এখনো  |
--- মা  আমি  খেয়ে  এসেছি  | শরীরটা  ভালো  লাগছিলোনা  তাই  চলে  এলাম  | তুমি  খেয়ে  নাও  | আমি  একটু  ঘুমাবো  আমায়  ডেকোনা  | 
  ঘরে  ঢুকে  সেই  পোশাক  পরেই সে  খাটের উপর  শুয়ে  পড়লো  | কি  এমন  হল  যে  তার  চোখ  থেকে  জল  পড়েই চলেছে  --- তা  সে  নিজেও  বুঝতে  পারছেনা  | নিজেকে  নিজে  প্রশ্ন  করে  , " আচ্ছা  কেন  রাহুলের  সঙ্গ আমার  এতো  ভালো  লাগে ? কেন  রাহুল  অন্য মেয়েদের  সাথে  সময়  কাটালে  আমার  এতো  রাগ  হয় ? রাহুলের  মুখ  থেকে  প্রশংসা  শুনতে  কেন  আমার  এতো  ভালো  লাগে ? রাহুল  অন্য মেয়েদের  প্রশংসা  করলে  কেন  তার  প্রতি  এতো  হিংসা  হয়  ?---- হঠাৎ  দরজায়  কড়া নাড়ানোর  শব্দ  | মনেমনে  রাগ  হয়  সৈরিতার  এতো  করে  মাকে বললাম  যেন  বিরক্ত  না  করে  ঠিক  আবার  খাওয়ার  জন্য  ডাকতে  এসেছেন  |
 দরজা  খুলে  দেখে  রাহুল দাঁড়িয়ে  হাতে  খাবারের  প্যাকেট  |
--- তুই  এখন  কেন  এসেছিস ? তোর  অদৃতা তোকে  ছাড়লো  ?
--- সর সর  -- ভিতরে  ঢুকতে  দে  --| খুব  তো  রাগ  দেখিয়ে  না  খেয়ে  দুমদাম  পা  ফেলে  চলে  আসলি  -- |
--- আমি  খাই  কি  না  খাই  তাতে  তোর  কি  ?
--- সেটা  যদি  বুঝতিস  তাহলে  তো  হয়েই  যেত  | খুব  খিদে  পেয়েছে  রে  --- আর  কথা  বাড়াসনা , চল  দুজনে  খেয়ে  নি  --|
--- তুই  কেন  খাসনি  ?
--- নিজেকে  প্রশ্ন  কর  উত্তর  পেয়ে  যাবি | 
 সৈরিতির মা  ঘরে  ঢুকে  দুটো  প্লেট  দিয়ে  গেলেন  | কারন  রাহুল  সৈরিতিদের বাড়িতে  এসে  প্রথমেই  ওর  মায়ের  সাথে  দেখা  করে  বলেছে  সৈরিতি রাগ  করে  না  খেয়ে  অঞ্জলি  দিয়েই  চলে  এসেছে  | তাই  দুজনের  খাবারটা  নিয়ে  সে  চলে  এসেছে  | রাহুলকে  খুব  স্নেহ  করেন  তিনি  | মাঝে  মধ্যেই  সে  এ  বাড়িতে  আসে  | দুজনের  মধ্যে  যে  একটা  সম্পর্ক  তৈরী  হয়েছে  তা তিনি  খুব  বুঝতে  পারেন  | এই  ব্যাপারে  তার  কোন  আপত্তিও  নেই  | দেখতে  সুন্দর  , স্বভাবচরিত্র  ভালো  , বড়লোকের  ছেলে  -- সুতরাং  আপত্তি  করার  কোন  প্রশ্নই  ওঠেনা  |
  রাহুল  খেতে  খেতে  বলে  ,
--- তোকে  একটা  কথা  বলা  হয়নি  --
--- কি  কথা  ?
--- আজকে  তোকে  খুব  সুন্দর  লাগছিলো  দেখতে  |
--- সেটা  এখন  মনে  হল  ?
--- না  তা  কেন ? সব  কথা  সবসময়  কি  বলা  যায়  ?
 --- ও  আমার  কথা  বলা  যায়না  অদৃতির কথা  বলা  যায়  |
--- সারাজীবন  মাথামোটাই  থেকে  গেলি  রে  -- | মা  সরস্বতীকে  অনেক  বলেছি  তোকে  যেন  একটু  বুদ্ধি  দেন  |
  রাহুল  কথাটা  বলেই  সৈরিতির মাথাটা  ধরে  আলতো সরিয়ে  দেয় |
     কলেজে  আর  মাত্র  কয়েকটা  মাস  | তার  পরেই যে  যার  ভুবনে  | কত  পরিচিত  , কাছের  বন্ধু  কতজনের  সাথেই  হয়তোবা  আর  জীবনেও  দেখা  হবেনা  | যার  যার  জীবনে  কেউবা  প্রতিষ্ঠিত  আর  কেউবা  আজীবন  জীবনযুদ্ধের  লড়াইয়ে  হেরো হয়েই  কাটিয়ে  দেবে  | স্কুল জীবনের  অনেক  বন্ধুই  হারিয়ে  গেছে  কলেজ  জীবনে  | রাস্তাঘাটে  কারো  সাথে  মাঝেমধ্যে  দেখা  হয়  আর  কেউবা  স্কুলছুটের  পর  অদেখাই  থেকে  গেছে  |
  রাহুল  সৈরিতিকে  প্রচন্ড  ভালোবাসে  | রাহুল  বুঝতে  পারে  সেও  তাকে  ভালোবাসে  | কিন্তু  সৈরিতি নিজের  মনের  কথা  নিজেই  বুঝতে  পারেনা  | ফাইনাল  ইয়ারে  ফাইনাল  পরীক্ষার  শেষ  কলেজের  দিন  বন্ধুদের  সাথে  পরামর্শ  করে  একটা প্লান করে  রাহুল  | সৈরিতি কলেজে  আসলে  রাহুল মুখ  কালো  করে  বলে ,
--- তোর  সাথে  একটা  কথা  আছে  -
--- এখনই  বলবি  --- তাড়াতাড়ি  বল  , আমার  কাজ  আছে  -
--- একটু  ওদিকে  চল  
-- কত  ঢং যে  তুই  জানিস  চল  কোথায়  যাবি ?
   কিছুটা  এগিয়ে  এসে  একটু  নির্জন  জায়গায়  দাঁড়িয়ে  বললো  ,
--- এখানে  বলা  যাবে  তো  ?
--- হ্যাঁ 
  রাহুল  মাথা  চুলকে  একটু  গম্ভীর  হয়ে  বললো  ,
-- আমার  বাবা  কলকাতা  থেকে  ট্রান্সফার  হয়ে  গেছেন  --
--- তো ? আমি  কি  করবো  ?
 রাহুল  কৃত্রিম রাগ  দেখিয়ে  বললো  ,
--- যা  শুনতে  হবেনা  তোর  , তোর  তাড়া আছে  তুই  চলে  যা  -
 রাহুল  পা  বাড়ায়  , পিছন  থেকে  সৈরিতি তার  হাত  টেনে  ধরে  বলে  ,
--- বাব্বা  আজ  যে  একদম  রেগে  ফায়ার  হয়ে  আছিস  | আচ্ছা  শুনছি  বল  |
--- আগামী  সপ্তাহেই  আমাদের  শিলিগুড়ি   চলে  যেতে  হবে  | পরীক্ষার  সময়  এসে  মাসির  বাড়ি  থেকে  পরীক্ষা  দেবো |
--- বুঝলুম  তা  আমাকে  কি  করতে  হবে  ?
  রাহুলের  ইচ্ছা  করছে  তখন  সৈরিতির মাথাটা  ধরে  কোন  দেওয়ালে  ঠুকে  দেয় | তবুও  দাঁতে দাঁত চেপে  বললো  ,
--- তোর  সাথে  আর  আমার  দেখা  হবেনা  |
--- ও  এই  কথা  | নাহলে  আর  কি  করা  যাবে  | চল  আজ  একটু  ফুচকা  খাওয়া  আমায়  |
  রাহুলের  সর্বশরীর  রাগে তখন  জ্বলে  যাচ্ছে  | তবুও  মুখে  হাসি  এনে  বললো  ,
--- চল  তাহলে  | অদৃতাকে ডেকে  নিই ওউ  বলছিলো  ফুচকা  খাবে  |
--- আমি  খাবোনা  , তুই  বরং  ওকেই  খাওয়া  আফটারঅল ও  তো  তোর  খুব  কাছের  ---
 রাগ  করে  সৈরিতি চলে  এলো  | কিন্তু  চলে  তো  এলো  মনটা  ওর  ভীষণ  খারাপ  হয়ে  গেলো  | কিছুতেই  বুঝতে  পারছেনা  কেন  এরকম  লাগছে  | তবে  কি  রাহুলের  সাথে  আর  দেখা  হবেনা  বলেই  কি  ওর  এরকম  লাগছে  | কিন্তু  রাহুল  তো  শুধু  বন্ধু  | বাড়ির  পথে  হাঁটতে হাঁটতে নিজের  সাথে  নিজেই  কথা বলতে  থাকে  সৈরিতা | রাহুলের  সাথে  আর  দেখা  হবেনা  ভাবলেই  চোখ  থেকে  জল  পড়ে যাচ্ছে  | "তবে  কি  এটাকেই  ভালোবাসা  বলে ? আমি  রাহুলকে  তাহলে  ভালোবাসি?  এইজন্যই  ওর  সাথে  অন্যকোন  মেয়েকে  দেখলে  আমার  রাগ  হয়  ?রাহুল  চলে  যাওয়ার  আগেই  ওকে আমার   বলতে  হবে  ওকে  আমি  ভালোবাসি ?" আবার  কলেজে  ফিরে  যাওয়ার  জন্য  পা  বাড়ায়  | রাহুলকে  ফোন  করে  | কিন্তু  ফোন  বেজে  যায়  রাহুল  ধরেনা | এবার  আর  ওর  রাগ  হয়না  | খুব  কষ্ট  হয়  | নিশ্চয়  অদৃতার সাথে  গল্প  করছে  | তিন  চারবার  ফোন  করার  পর  রাহুল  ধরে  মিথ্যা  বলে  ,
--- আরে অদৃতা আর  আমি  ফুচকা  খাচ্ছিলাম  | বল  কি  হয়েছে  ?
--- তুই  কোথায়  ?
--- কলেজের  সামনে  রাস্তায়  --
--- দাঁড়া আমি  আসছি  --
  আসলে  রাহুল  তখন  কলেজের  মাঠে  বসে  ওর  বন্ধুদের  কাছ  থেকে  সৈরিতির মুখ  থেকে  কিভাবে  কথা  বের  করা  যায়  তার  পাঠ নিচ্ছিলো  | সে  সৈরিতিকে পুনরায়  ফোন  করে  ওখানেই  আসতে বলে  | সৈরিতি ঘেমে  নেয়ে একসার  হয়ে  হন্তদন্ত  হয়ে  রাহুলের  কাছে  এসে  পৌঁছায়  |
--- বল  কি  বলবি  তাড়াতাড়ি  বল  বাড়িতে  অনেক  কাজ  রয়েছে  | মাকে প্যাকিংয়ের  ব্যাপারে  হেল্প  করতে  হবে  ---
 সৈরিতি আস্তে  আস্তে  রাহুলের  একদম  কাছে  চলে  যায়  | রাহুল  কিছু  বোঝার  আগেই  এদিকে  ওদিকে  তাকিয়ে  আলতো করে  রাহুলের  ঠোঁঠে চুমু  খায়  | আর  বলে  ," ভালোবাসি  তোকে  |"
--- অবশেষে  বুঝলি  তাহলে  --
 মাথা  নিচু  করে  সৈরিতি ঘাড় নেড়ে  বলে  ,
--- হয়তো  কোনদিনও  বুঝতে  পারতামনা  কিন্তু  তুই  শিলিগুড়ি  চলে  যাবি শুনে  তোর  সাথে  আর  দেখা  হবেনা  ভেবে  আমার  ভিতরের  কষ্ট  আমায়  বুঝিয়ে  দিয়েছে  আমি  তোকে  ভালোবাসি  |
--- কিন্তু  আমি  তো  কোথাও  যাচ্ছিনা  
--- মানে  ?
 অদৃতা সহ আরো  কিছু  বন্ধুরা  তখন  ঝোপঝাড়  আর  গাছের  আড়াল  থেকে  হৈহৈ  করে  বেরিয়ে  এসে  সকলে  চিৎকার  করে  বললো  ,
-- আরে  গর্দভ  এটা তোর  মুখ  থেকে  কথা  বের  করার  জন্য  অদৃতি  এই  বুদ্ধিটা  দিয়েছিলো  | 
 প্রথমে  লজ্জায়  লাল  হয়ে  গেলো  সৈরিতি নিজের  মনে  নিজেই  ছোট  হয়ে  গেলো  অদৃতিকে  নিয়ে  রাহুলকে  নানান  কথা  শুনানোর  জন্য  -- যখন  সে  নিজের  মনে  নানান  ভাবনায়  ব্যস্ত  তখন  বন্ধুদের  উর্দ্যেশ্যে  রাহুল  বলে  উঠলো  ,
-- বুঝতে  পারছিস  তোরা  আমার  ভবিৎষত  এই  মাথা  মোটাটাকে  নিয়ে  আমায়  সারাজীবন  কাটাতে  হবে  --
 সঙ্গে  সঙ্গে  সৈরিতা নিজ  মূর্তি  ধারণ  করলো  
-- শয়তান  একটা  , মিথ্যেবাদী  আমাকে  কষ্ট  দেওয়ায়  শুধু  তোর  উর্দ্যেশ্য  ---
  সৈরিতির কান্ড  দেখে  সবাই  হোহো  করে  হাসতে লাগলো  |
 
 
--- 
   

Tuesday, February 11, 2020

বেশ করেছি

#আমার_লেখনীতে  
     নন্দা  মুখাৰ্জী  রায়  চৌধুরী  
 
  বেশ  করেছি  

   অত্যাচারী  মদ্যপ  স্বামীর  সকল  অত্যাচার  মুখ  বুজে  সহ্য করে  করে  যেন  সবংসহা হয়ে  গেছে  শ্রাবনী  | কোনকিছুতেই  তার  আজ  আর  কিছু  যায়  আসেনা  | ফিরে যাওয়ারও কোন  রাস্তা  নেই  | রেললাইনের  পাশে  ঝুপড়িতে  জম্ম  তার  | বাবা  রিকশাচালক  আর  মা  লোকের  বাড়িতে  রান্নার  কাজ  করে  | অনেক  কষ্ট  করে  শ্রাবনী  ও  তার  ভাইকে  তারা  লেখাপড়া  শেখাচ্ছেন | কিন্তু  শ্রাবনীর  পড়াশুনায়  মন  ছিলোনা  | নবম  শ্রেণী  পর্যন্ত  পড়েই সে  পড়াশুনার  ইতি  টানে  | এরই  মধ্যে  সে  প্রেমে  পরে  বয়সে  দশ  বছরের  বড়  লরিচালক  রমেশের  | একদিন  কাউকে  কিছু  না  বলে  রমেশের  সাথে  সে  ঘর  ছাড়ে | সদ্য যৌবনা  শ্রাবনীর  চোখে  ছিল  নুতন  জীবনের  অনেক  স্বপ্ন  | ভেবেছিলো  বাবার  বাড়ির  দারিদ্রতা  নুতন  জীবনে  থাকবেনা  | রমেশ  মাঝেমধ্যে  এসে  তাকে  নিয়ে  নানান  জায়গায়  ঘুরতে যেত আর  বেশ  ভালোমন্দ  খাওয়াতো  | সরল  মনে  শ্রাবনী  ভেবেছিলো  রমেশের  অনেক  টাকা  আছে  | তাই  মনে  অনেক  স্বপ্ন  নিয়ে  সে  তার  বাবা , মা  আর  ভাইকে  ছেড়ে  ছোট  একটা  মন্দিরে  বিয়ে  করে  রমেশের  সাথে  তার  বাড়ি  আসে  | কিন্তু  সেখানে  প্রবেশ  করেই  সে  প্রথম  ধাক্কাটা  খায়  | বস্তির  একটা  ছোট্ট  ঘর  | চারিপাশে  দারিদ্রতার  ছাপ স্পষ্ট  | মা  অনেক  কষ্টে  বাড়িতে  একটা  গ্যাস  কিনেছিলেন  এখানে  শত নোংরা  একটি  স্টোভ  | একই  ঘরের  মধ্যে  থাকা, খাওয়া  আর  রান্না  | চোখ  ফেঁটে জল  বেরিয়ে  আসতে চাইছে  ; আপ্রাণ  চেষ্টা  করে  চোখের  জল  আটকে  রাখার  চেষ্টা  করে  শ্রাবনী  | প্রথম  রাতের  স্বামীর  আদরও তার  কাছে  অসহনীয়  হয়ে  উঠে  | মুহূর্তেই  তার  সমস্ত  স্বপ্ন  ভেঙ্গেচুরে খানখান  হয়ে  যায়  যার  শব্দ  সে  একাই বুকের  মাঝে  অনুভব  করে  , পাশের  মানুষটি  ঘুনাক্ষরেও টের  পায়না  | সেদিনের  সেই  ভাঙ্গা স্বপ্নকে  জোড়াতালি  দিয়ে  বিয়ের  একমাসের  মাথায়  লোকের  বাড়ি  কাজ  নিয়ে  অন্তত  পেট  পুরে দুবেলা  খাওয়ার  সংস্থান  করে  | বিয়ের  পরেরদিন  থেকেই  সে  বুঝতে  পারে  স্বামী  তার  মদ্যপ  | আর  মদ  পেটে পড়লে  তার  কোন  হুশ থাকেনা  | তখন  সে  কি  বলছে  আর  কি  করছে  পরেরদিন  তার  কিছুই  মনে  থাকেনা  | প্রথম  প্রথম  কয়েকদিন  সে  রমেশকে  বুঝানোর  চেষ্টা  করেছে  | কিন্তু  ফল  হয়েছে  হিতে  বিপরীত  |  কাজ  শেষ  মদ  খেয়ে  বাড়িতে  ফিরে সে  সমস্ত  রাগের  প্রতিশোধ  নেয়  শ্রাবনীর  শরীরে  অত্যাচারের  কালো  দাগ  ফেলে  | রমেশের  রোজ  রাতের  সোহাগ  তার  কাছে  নিত্যদিনের  ধর্ষণ  বলে  মনেহয় | ইচ্ছার  বিরুদ্ধে  নিজেকে  সে  আত্মসমর্পণ  করে  | মাঝে  মাঝে  নিজেকে  তার  শেষ  করে  দিতে  ইচ্ছা  করে  | হয়তো  একদিন  তাইই সে  করতো  | কিন্তু  বিয়ের  ছমাসের  মাথায়  সে  নিজের  ভিতরে  অন্য আর  একটি  প্রাণের  অস্তিত্ব  টের  পায় | এ  নিয়ে  রমেশের  কোন  মাথা  ব্যথা  নেই  | নিজের  উদ্যোগে  পাশের  ঘরের  দিদির  সাথে  সে  হাসপাতালে  কার্ড  করে  | যথাসময়ে  তার  একটি  সুন্দর  ফুটফুটে  মেয়ে  হয়  | মাসখানেক  পর  থেকেই  সে  মেয়েকে  কোলে  নিয়েই  লোকের  বাড়ি  কাজ  করতে  শুরু  করে  | তাদের  ঘরের  কোন  একজায়গায়  শুইয়ে  রেখে  সে  কাজ  করতে  থাকে  | কেঁদে  উঠলে  একটু  বুকের  দুধ  খাইয়ে  যায়  | সারাদিন  এই  অক্লান্ত  পরিশ্রম  করে  সন্ধ্যায়  ঘরে  ফিরে রমেশের  খাবারের  ব্যবস্থা  করে  | তানাহলে  রমেশ  ঘরে  ঢুকে  তান্ডব  চালায়  | 
   দেখতে  দেখতে  মেয়ের  বয়স  ছমাস হয়ে  যায়  | এখন  সে  মাঝে  মধ্যে  পাশের  ঘরের  দিদির  কাছে  তার  মেয়েকে  রেখেও  কাজে  যায়  | দিদি  খুব  যত্নে  তার  মেয়েকে  রাখে  | খিদে  পেলে  কখনো  জলে  বিস্কুট  গুলে আবার  কখনোবা  সুজি  খাইয়ে  দেয় যার  ব্যবস্থা  শ্রাবনী  নিজেই  করে  রেখে  যায়  | একদিন  কাজের  শেষে  ঘরে  ফিরে মেয়েকে  আনতে গেলে  পাশের  ঘরের  রানুদি  তাকে  বলে  , 
--- আজ  রমেশ  একজন  ভদ্রলোক  আর  একজন  ভদ্রমহিলাকে  নিয়ে  দুপুরের  দিকে  বাড়ি  এসে  কিছুক্ষনের  জন্য  মেয়েকে  নিয়ে  গেছিলো  | তাদের  সাথে  কিসব  টাকাপয়সা  নিয়েও  কথা  বলছিলো  | জানিনা  কি  ব্যাপার  তবে  তুই  কাল  থেকে  মেয়েকে  নিয়েই  কাজে  যাস  |
  খুব  চিন্তায়  পড়ে গেলো  শ্রাবনী  | কিন্তু  এখন  মেয়ে  উপুড়  হতে  শিখেছে  , মুখ  চিনতে  শিখেছে  কাজের  বাড়িতে  শুইয়ে  কাজ  করতে  গেলে  চিৎকার  করে  খুব  কাঁদে  | শ্রাবনীর  মনে  কোন  খারাপ  চিন্তা  কখনোই  আসেনি  | তাই  সে  তার  রানুদিকে  অনুরোধ  করে  তার  মেয়েকে  রাখার  | অনিচ্ছা  সর্ত্বেও  রানু  মেয়েটিকে  রাখে  | সেদিন  কিছু  না  ঘটলেও  পরদিন  রমেশ  আবার  ওই  দুজনকে  নিয়ে  তার  বস্তির  ঘরে  আসে  | তাদের  ঘরে  বসিয়ে  রেখে  নিজের  মেয়ে  স্মিতাকে  নিয়ে  আসে  | রানু  তার  কাছে  দিতে  অস্বীকার  করলে  বলে,  
" একটু  পরেই দিয়ে  যাচ্ছি  |" রানুর  সন্দেহ  হয়  | সে  বস্তির  কয়েকজনকে  ডেকে  এনে  কাছাকাছি  এদিকে  ওদিকে  দাঁড়িয়ে  থাকতে  বলে  সজাগ  হয়ে  | কিছুক্ষন  পরে  স্মিতাকে  তোয়ালে  মুড়িয়ে  রমেশ  নিজেই  রাস্তার  দিকে  হাঁটতে থাকে  | একটু  দূরে  দূরে  মহিলা  ও  পুরুষটি  | বস্তির  লোকগুলিও  ওদের  অনুসরণ  করে  | কিছুদূর  গিয়ে  তারা  দেখে  একটি  গাড়ি  দাঁড়ানো  | প্রথমে  মহিলাটি  গাড়িতে  ওঠে  পরে  রমেশ  বাচ্চাটিকে  যখন  তার  কোলে  দিতে  যায়  তখনই বস্তির  লোকগুলি  হৈহৈ  করে  পরে  রমেশের  উপরে  চড়াও  হয়  | রানু  ছুটে গিয়ে  বাচ্চাটিকে  তার  নিজের  কোলে  তুলে  নেয়  | সুযোগ  বুঝে  ড্রাইভার  গাড়ি  চালিয়ে  দেয় | কোনক্রমে  চলন্ত  গাড়ির  বাইরে  থাকা  লোকটি  উঠে  পরে  | সকলে  রমেশকে  নিয়ে  এতো  ব্যস্ত  ছিল  ওই  লোকটির  কথা  সেই  মুহূর্তে  কারোই  মাথায়  আসেনি  | সেদিন  রমেশ  বস্তির  লোকগুলির  কাছে  খুব  মার খায়  কিন্তু  তার  মুখ  থেকে  একটি  কথাও  কেউ  বের  করতে  পারেনা  | সন্ধ্যায়  ঘরে  ফিরে শ্রাবনী  সব  শুনে  তার  আর  বুঝতে  বাকি  থাকেনা  যে  রমেশ  তার  মেয়েকে  টাকার  লোভে  বিক্রি  করে  দিতে  চেয়েছিলো  | সে  তার  রানুদিকে  অনুরোধ  করে  মেয়েটিকে  আর  কিছুক্ষণের জন্য  রাখতে  | ঝড়ের  গতিতে  সে  নিজের  ঘরে  ফিরে এসে  দেখে  কানে  হেডফোন  দিয়ে  চোখ  বুজে  সে  মোবাইলে  গান  শুনছে  | সে  তার  বঁটিটা হাতে  তুলে  নিয়ে  এলোপাথাড়ি  কোপ মারতে  থাকে  রমেশের  উপর  | এমনিতেই  সকালে  মার খেয়ে  রমেশ  কিছুটা  নিস্তেজ  হয়েছিল  তারউপর  শ্রাবনীর  এই  হঠাৎ  হামলায়  সে  বাধা  দেওয়ার  বিন্দুমাত্র  সুযোগ  পাইনি  | সারা  ঘর , বিছানা  রক্তে  ভেসে  যাচ্ছে  | রমেশের  কোন  সারা  নেই  কিন্তু  পাগলের  মত  শ্রাবনী  তার  শরীরে  একের  পর  এক  কোপ মেরেই  চলেছে  আর  চিৎকার  করে  বলে  চলেছে  ,
--- এতদিন  ধরে  সব  অত্যাচার  আমি  সহ্য করেছি  আমার  যাওয়ার  কোন  জায়গা  নেই  বলে  কিন্তু  আজ  তুই  আমার  মেয়ের  দিকে  হাত  বাড়িয়েছিস আমি  তোকে  আর  বাঁচতে  দেবোনা  | 
 ইতিমধ্যে  ঘরে  লোক  জড়ো হয়ে  গেছে  | একজন  গিয়ে  শ্রাবনীর  হাত  থেকে  জোর  করে  বঁটিটা কেড়ে  নেয় | শ্রাবনী  মেঝেতে  বসে  পড়ে | কিছুক্ষন  পরে  সে  মেঝেতেই  অজ্ঞান  হয়ে  পড়ে যায়  | যখন  তার  জ্ঞান  ফেরে  চোখদুটি  জবাফুলের  মত  লাল  ঘোলাটে  দৃষ্টি  | শুধু  একটি  কথায়  বলে  চলেছে  " বেশ  করেছি |" পুলিশ  যা  জানতে  চাইছে  উত্তর  -" বেশ  করেছি "| পুলিশ  যখন  তাকে  নিয়ে  যাচ্ছে  তার  রানুদি  এসে  তার  কোলে  স্মিতাকে  দিতে  গেলে  সে  ভয়ে  আতঙ্কে  দুপা  পিছিয়ে  গিয়ে  নিজের  হাতদুটির  করতলের  দিকে  এক  দৃষ্টিতে  তাকিয়ে  থাকে  | পুলিশ  তাকে  নিয়ে  চলে  যায়  | সাতদিন  পরে  রানু  লোক  মারফত  জানতে  পারে  শ্রাবনীর  ঠাঁই হয়েছে  পাগলাগারদে  |

Saturday, February 1, 2020

ডাইরীর পাতা

 
      ডাইরীর পাতা  
   

    একাত্তর  সালের  পূর্ববাংলার  দাঙ্গার   সময়  আমাকে  কোলে  নিয়ে  বাবা  মা  যখন  গ্রামের  এক  বাড়ি  থেকে  অন্য বাড়িতে  দু  এক  রাত আশ্রয়  নেন  তখন  আর  একজনের আশ্রয়স্থলও  হয়  ওই বাড়িগুলি   | সে  হল আমার  রেশমিদিদির  | পশ্চিম  পাকিস্তানের  মিলিটারির  আক্রমনে  যখন  আমাদের  গ্রামের  হাজার  হাজার  ঘরবাড়ি  পুড়িয়ে  ছাই করে  দিচ্ছে  , নিরীহ  মানুষগুলিকে  বিনা  কারনে  গুলি  করে  মারছে -- | তাদেরই  শিকার  হয়েছিল  রেশমিদিদিদের  পরিবার  | রেশমির  বাবা  দিনমজুর  আনোয়ার  হোসেন  | পুরো গ্রাম  যখন  গেরিলাবাহিনীর হাতের  মুঠোই চলে  আসে  ঠিক  তখন  আনোয়ার  চাচা  নারকেল  গাছে  উঠে  নারকেল  পাড়ছিলেন  | মিলিটারিরা  তাকে  দিয়ে  ডাব পাড়িয়ে  খেয়ে  নিয়ে  তাকেই  গুলি  করে  মারে  | দূর  থেকে  গুলি  করে  খড়ের  ছাউনি  দেওয়া  বাড়িতে  আগুন  ধরিয়ে  দেয় | চাচি আর  দুই  ছেলেমেয়ে  ঘরের  ভিতর  আগুনে  পুড়ে  মারা  যান  | রেশমিদিদির  বয়স  তখন  পাঁচ  কি  ছবছর | সে  তখন  বাগানে  গেছিলো  শাকপাতা  কুড়াতে  দুপুরে  ভাতের  সাথে  খাওয়া  হবে  বলে  | বাড়িতে  এসে  দেখে  দাউদাউ  করে  আগুন  জ্বলছে  | ভয়ে  আতঙ্কে  অজ্ঞান  হয়ে  পরে  যায়  | বাবা  মায়ের  কাছে  গল্প  শুনেছি  ওই  আক্রমনের  সময়  বাবা  আর  মা  আমাকে  নিয়ে  বাড়িরই  এক  জঙ্গলে  আশ্রয়  নিয়েছিলেন | জঙ্গলে  বসেই  দেখতে  পান  পাশে  আনোয়ার  চাচার  বাড়ি  দাউ  দাউ  করে  জ্বলছে  | কিন্তু  বেরিয়ে  আসার  সাহস  দেখাতে পারেননি | সন্ধ্যার  পর  অন্ধকার  নেমে  এলে  আমাকে  কোলে  করে  বাবা  ও  মা  জঙ্গল  থেকে  বেরিয়ে  আসেন  | আমাকে  ও  মাকে কয়েকটা  বাড়ির  পর  গফুর  চাচাদের  বাড়িতে  রেখে  বাবা  যান  আনোয়ার  চাচার  খোঁজে  | কয়েকজন  গ্রামের  লোকের  কাছেই  জানতে  পারেন  পুকুরপাড়ে  নারকেল  গাছের  তলায়  আনোয়ার  চাচার  মৃতদেহ  পরে  আছে  | এইরূপ  এখানে  ওখানে  প্রচুর  মৃতদেহ  পরে  থাকায়  গ্রামের  কিছু  লোক  মিলে কিছু  দেহের  সৎকার  করা  যদিও  সম্ভব  হয়  বাকি  দেহগুলি  শেয়াল  কুকুরের  ছিড়ে খায়  | আনোয়ার  চাচার  বাড়ির  দোরগোড়ায়  এসে  যখন  সকলে  জমা  হলেন  বড় টর্চের  আলোতে  দেখতে  পেলেন  শুধু  ছাই আর  ছাই | হঠাৎই  তারা  শুনতে  পান  একটি  বাচ্চার  কাতর  কান্নার  আওয়াজ  | সকলে  সেদিকেই  ছোটেন  | রেশমিদিদিকে  পাড়ার  অন্য কেউ  রাখতে  তেমন  আগ্রহ  প্রকাশ  না  করাতে বাবা  ই  তাকে  কোলে  করে  তুলে  নিয়ে  মায়ের  কোলে  এনে  বসিয়ে  দিয়ে  বলেন  ,
-- মেয়েটি  তার  জীবনের  সব  খুঁইয়েছে| এই  পৃথিবীতে  আপন  বলতে  ওর  আর  কেউ  নেই  | আজ  থেকে  আমাদের  দুটি  মেয়ে  | 
  মা  ও  দুহাতে  রেশমিদিদিকে  বুকের  সাথে  চেপে  ধরেন  আর  বাবাকে  বলেন  ,
--- হ্যাগো এখন  কি  হবে?  কোথায়  থাকবো?  কি  খাবো ?
--- চিন্তা  কোরোনা ভোরের  আলো ফুটুক  সকলের  যা  হবে  আমাদেরও  তাই  হবে  | গফুর  তো  বলেছে  যে  কটাদিন খুশি  ওর  বাড়ি  আমরা  থাকতে  পারবো  | 
   আমার  বাবা  ছিলেন  একজন  ডাক্তার  | বহু  দূরদূরান্ত  থেকে  আরোগ্য  লাভের আশায়  বারবার  লোকে  ছুটে আসতো | গ্রামের   অধিকাংশ  গরীব মানুষই  ছিল  বিনা  পয়সার  রোগী  | তাদের  চিকিৎসা  করে  ওষুধ  কেনার  টাকা  দিতেও  কখনো  বাবা  কুন্ঠাবোধ  করেননি  | আর  অন্দরমহলে  মা  ছিলেন  দেবী  অন্নপূর্ণা  | দরিদ্র  মানুষ  চিকিৎসার  জন্য  এলেই  পেট  ভরে  ভাত তারা  খেতে  পারবে  এ  তারা  জেনেই  আসতো | দেশের  এই  চরম  দুর্দিনের  সময়  সেই  সব  মনে  রেখেই  হয়তো  ঈশ্বরের  দূত হিসাবে  অনেক  মানুষের  কাছ  থেকেই  উপকার  আমরা  পেয়েছি  | গফুর  চাচার  বাড়িতে  দিন  পনের  থাকার  পর  বাবার  এক  পেসেন্ট একদিন   রাতেরবেলা  এসে  হাজির  | তিনি  আমাদের  নিয়ে  যেতে  চান  তার  বাড়ি মোল্লাহাট  থানার  অন্তগত   গাওলায় | সেখানে  নাকি  পাকিস্তানী  বাহিনীর  কোন  উপদ্রব  নেই  | আছে  দেশকে  পরাধীনতার  শৃংখল থেকে  মুক্ত  করার  জন্য  সশস্ত্র  মুক্তিযোদ্ধা  বাহিনী  | আর  সেখানে  আমার  বাবা অপরেশ  ব্যানার্জির  কাজ  হচ্ছে  আহত  মুক্তিযোদ্ধা  বাহিনীর  সেবা  করা  | বাবা  এককথায়  রাজি  হয়ে  গেলেন  | এ  কটাদিন বাবা  চুল  দাঁড়ি না  কাটার  কারনে সেগুলো  বেশ  বড়  হয়ে  গেছিলো  | গ্রামে  গ্রামে  শুরু  হয়েছে  তখন দেশের  খেয়ে  দেশের  পরে   রাজাকার  বাহিনীর  উপদ্রব  | তারা  তখন  বুদ্ধিজীবীদের  ধরে  ধরে  হত্যালীলার  মেতেছে  | গ্রামের  " মোস্ট  ওয়ান্টেড  পার্সন " এর  মধ্যে  বাবার  নাম  দ্বিতীয়  নম্বরে  | বাবার  ওই  চুল  ও  দাঁড়ি বাবাকে  বাঁচতে  সাহায্য  করেছে  | বাবাও  তখন  প্রতিজ্ঞা  করলেন  দেশ  স্বাধীন  না  হলে  তিনি  তার  চুল  ও  দাঁড়ি কাটবেননা  | 
  রাতেরবেলা  নৌকা  করে  আমাদের  নিয়ে  নৌকার  মাঝি  হয়ে  দাঁড়  টেনে  বাবা  পৌঁছালেন  গাওলায় | 
  বাবা  যখন  তখন  বাড়ি  থেকে  বেরিয়ে  পড়তেন  যে  কারো  ডাকে  | মায়ের  কাছে  গল্প  শুনেছি  সকালবেলা  ঘুম  থেকে  উঠলেই  কেউ  মাছ  কেউবা  আনাজপাতি  নিয়ে  আমাদের  দোরগোড়ায়  হাজির  হয়ে  যেতেন  | কোন  কষ্ট  ঐসময়  আমরা  পাইনি  |  দেশ  স্বাধীন  হওয়ার  ঠিক  সপ্তাহখানেক  আগে  বাবা  অন্যান্য  লোকজনের  সাথে  মুক্তিযোদ্ধাদের  শিবির  থেকে  তাদের  চিকিৎসা  দিয়ে  ফিরছিলেন  তখন  বিষধর  সাপের  কামড়ে  বাবা  মারা  যান  | বড়  হয়ে  মায়ের  কাছে  শুনেছি  বাবা  মৃত্যুর  আগে  মায়ের  হাত  ধরে  বলে  গেছিলেন  " সবসময়  মনে  রেখো  আমাদের  কিন্তু  দুই  মেয়ে  | রেশমির  বাবা  আমি  আর  মা  তুমি  - সারা  পৃথিবী  যেন  এটাই  জানে  | দেশ  একদিন  স্বাধীন  হবেই  | মেয়েদুটিকে  যথেষ্ট  শিক্ষায়  শিক্ষিত  কোরো তাহলেই  আমার  আত্মা  শান্তি  পাবে |"
  দেশ  স্বাধীন  হওয়ার  পর  মা  আমাকে  ও  রেশমিদিদিকে  নিয়ে  গ্রামের  বাড়ি  আসেন  | কিন্তু  জাতপাতের  বিচারে  হিন্দু  ব্রাহ্মণ  ঘরে  মুসলমান  ঘরের  মেয়েকে  নিয়ে  একসাথে  খাওয়াবসা  গ্রামের  লোকজন  ঠিক  ভালোভাবে  মেনে  নিলোনা  | মা  জলের  দামে  জমিজমা  , বাড়িঘর  সব  বিক্রি  করে  গফুরচাচার  সাহায্যে  অজানা  এক  শহরে  এসে  ঘর  ভাড়া  নিয়ে  থাকতে  শুরু  করলেন  | রেশমিদিদিকে  স্কুলে  ভর্তি  করলেন  | রেশমি  ব্যানার্জি  বাবা  অপরেশ  ব্যানার্জি  | যথা সময়মত  আমিও  স্কুলে  ভর্তি  হলাম  | দিদি  আমার  থেকে  তিন  বছরের  বড়  | মা  সারাটাদিন  লোকের  কাঁথা সেলাই  করে  , ছোটছোট  বাচ্চাদের  পড়িয়ে টাকা  রোজগার  করার  চেষ্টা  করতেন  | জমিজমা  বিক্রির  টাকা  না  পারতে মা  তুলতেননা  | ওটা  আমাদের  দুবোনের  উচচশিক্ষার্থের  জন্য  গচ্ছিত  ছিল  | দিদি  ছিল  অসাধারণ  মেধাবী  | সে  তার  মেধাশক্তির  পরিচয়  দিয়ে  ডাক্তারিতে  সুযোগ  পেয়ে  গেলো  | মা  ভীষণ  খুশি  হলেন  | আমাদের  ডেকে  বললেন  , " আজ  তোদের  বাবা  বেঁচে  থাকলে  খুব  খুশি  হতেন  |" মা  আমাদের  দুজনকে  জড়িয়ে  ধরে  খুব  কাঁদলেন  | 
  পাঁচ  বছরের  শিশুর  জীবনে  ঘটে  যাওয়া  ঘটনা  স্বপের  মতোই  আবছা  হয়ে  যায়  | আমার  রেশমিদিদিও  তার  ব্যতিক্রম  নয়  | সেও  ভুলে  গেছে  তার  জীবনের  অতীত  | পড়াশুনায়  আমি  ছিলাম  মধ্যমমানের  | উচ্চশিক্ষা  নেওয়ার  মত  ব্রেন  আমার  নয়  | মা  চেষ্টা  করেছিলেন  এবং  এও বুঝেছিলেন  আমার  দ্বারা  তা  সম্ভব  নয়  | ঘষেমেজে  গ্রাজুয়েশনটা করলাম  |মায়ের  বয়স  হয়েছে  দুই  দুটি  যুবতী  মেয়ে  | তাদের  বিয়ে  থা  দিতে  হবে  দিদি  নিজের  পায়ে  না  দাঁড়িয়ে  বিয়ে  করবেনা অতএব  ' মা  তুমি  আগে  বোনের  বিয়ে  দাও  |' শুরু  হল  আমার  জন্য  ছেলে  দেখা  | সুন্দরী  বলতে  যা  বোঝায়  তা  আমি  কোনদিনও  ছিলামনা  | আমার  বিয়ের  জন্য  ছেলে  পেতে  প্রায়  দুবছর  লেগে  গেলো  মায়ের  | দিদিরও  ডাক্তারী পড়া  শেষ  | সাংসারিক  পরিস্থিতিরও  কিছুটা  উন্নতি  হয়েছে  ততদিনে  | কারন  আমরা  দুবোন  মিলে বাড়িতেই  একটা  কচিনসেন্টার  খুলে  বেশ  কিছু  ছেলেমেয়েদের  পড়ানোর  ব্যবস্থা  করেছি  | 
  আমার  বিয়ের  মাত্র  পনেরদিন  বাকি  | মা  ও  দিদির  দম ফেলার  ফুসরৎ নেই  | মাঝে  মাঝে  দিদির  নাইট  ডিউটি  থাকে  | বাড়িতে  এসে  মাকে সাহায্য  করে  বেশি  আর  ঘুমায়  কম  | একদিন  হাসপাতাল  থেকে  ফিরে দিদি দুপরে   ঘরে  বিশ্রাম  নিচ্ছে  আমি মায়ের  হাতে  হাতে  কাজ  করছি  হঠাৎ  দরজায়  কড়া নাড়ার  শব্দে  আমার  আগেই  মা  উঠে  দরজা  খুলতে  যান  আর  ঠিক  তখনই মেঝেতে  রাখা  সুটকেসে  বেঁধে  মা  পরে  গিয়ে  গোড়ালির  হাড় ভেঙ্গে যায়  | 
  অপারেশন  করে  বন্ডে দিদি  সই  করে  বিয়ের  দুদিন  আগে  মাকে  হাসপাতাল  থেকে  দিদি  বাড়ি  নিয়ে  আসে  | একা হাতে  সমস্ত  কর্তব্যকর্ম  করে  চলে  | কিন্তু  সমস্যা  বাধে  সম্প্রদানের  সময়  | কথা  ছিল  মা  সম্প্রদান  করবেন  | কিন্তু  এই  অবস্থায়  মায়ের  নিচুতে  বসা  একদম  বারণ| দিদি  গিয়ে  মায়ের  কাছে  অনুমতি  চাইলো  আমাকে  সম্প্রদান  করার  জন্য  | মা  দিদিকে  বুকে  জড়িয়ে  ধরে  কাঁদতে  কাঁদতে  অনুমতি  দিলেন  | পরেরদিন  আমি  শ্বশুরবাড়ি  চলে  আসি  |
  মায়ের  শত অনুরোধ  সর্ত্বেও  দিদি  বিয়েতে  রাজি  হয়না  | দিদির  বক্তব্য  সে  চলে  গেলে  তার  মাকে কে  দেখবে ? আমার  বিয়ের  পাঁচবছর  পর  মা  ও  একদিন  ঘুমের  মধ্যেই  চলে  যান  | সেদিন  মা  খাওয়াদাওয়ার  পর  খাটে শুয়ে  দিদিকে  ডেকে  বলেন  ," মা  রেশম  ( এই  নামেই  মা  দিদিকে  ডাকতেন  ) আমাকে  একগ্লাস  জল  দেতো" দিদি  মায়ের  হাতে  জলটা  দিয়ে  বলে  ," মা  তুমি  তো  এই  সময়  কখনোই  জল  খাওনা  আর  খেলেও  নিজে  উঠে  গিয়ে  খাও  | তবে  কি  তোমার  শরীর  খারাপ  করছে  আমায়  বলো মা |" মা দিদির  কথায়  হেসে  পরে  বলেন , " ওরে  আমার  শরীর  খারাপ  লাগলে  তোকে  তো  সকলের  আগেই  জানাবো  | তুই  তো  আমার  ডাক্তার  মেয়ে  | আমার  গর্ব  আমার  অহংকার  |"
 কিন্তু  মা  দিদিকে  তার  শরীর  খারাপের  কথা  জানানোর  আর  সুযোগই  পেলেননা  | দিদিও  মায়ের  পাশে  থেকে কিচ্ছুটি টের  পেলোনা  |
দিদি  সম্পূর্ণ  একা হয়ে  পরে  | ওই  বাড়িতে  বাস  করা  তার  পক্ষে  অসম্ভব  হয়ে  পরে  | সারাটা  জায়গায়  মায়ের  স্মৃতি  ছড়ানো  | সে  সিদ্ধান্ত  নেয়  অন্য কোথাও  ট্রান্সফার  নিয়ে  চলে  যাবে  | এই  পাঁচ  বছরে  ডাক্তার  হিসাবে  দিদির  খুব  নামডাক   হওয়ায়  সে  তার  পছন্দমত  জায়গায়  ট্রান্সফার  লেটার  পেয়ে  যায়  | আমায়  চিঠি  দিয়ে  সবকিছু  জানায়  | 
   একদিন  সন্ধ্যায়  মেয়ে  তার  ঘরে  বসে  পড়ছে  ওর  বাবা  তখনও অফিস  থেকে  ফেরেনি  হঠাৎ  কলিংবেলটা  বেজে  ওঠে  | খুলে  দেখি  দিদি  দাঁড়িয়ে  | আমি  তো  দুই  হাতে  দিদিকে  ঝাপটে ধরে  বকবক  করেই  চলেছি  কিন্তু  দিদি  অদ্ভুতভাবে  নীরব  |
--- দিদি  তুই  ঠিক  আছিস  তো ? তুই  এতো চুপচাপ  কেন  রে  ?
  দিদি  কোন  উত্তর  না  দিয়ে  ব্যাগ  থেকে  একটা  পুরনো ডাইরী বের  করে  আমার  হাতে  ধরিয়ে  দেয় আর  বলে  ,
--- বাবার  ডাইরী , মায়ের  আলমারির  মধ্যে  ছিলো  | বাবা  এই  ডাইরীতে  যা  লিখে  গেছেন  তা  সব  সত্যি  রে  বোন  | আমি  তোদের  কেউনা  | তোদের  পাশের  বাড়ির  অতি দরিদ্র  এক  মুসলমান  পরিবারের  মেয়ে  | 
  দিদি  হাউ  হাউ  করে  কাঁদছে  | আমি  তাড়াতাড়ি  দিদির  মার্ক  করা  পাতাগুলো  দম বন্ধ  করে  এক  নিঃশ্বাসে  পড়ে পুরো  থ  হয়ে  যাই  | দিদির  কান্না  দেখে  দিদিকে  জোরে  বুকের  সাথে  চেপে  ধরে  বলি  ,
-- বাবা  মৃত্যুর  সময়  মাকে যে  কথা  বলেছিলেন  মা  তা  অক্ষরে  অক্ষরে  পালন  করেছেন  | এতদিন  পর্যন্ত  মা  ছাড়া  আর  কেউই  জানতো  না  আমরা  আপন  সহোদরা  নই | আজ  যখন  আমরা  দুজনে  জেনেই  গেছি  আয় দিদি  দুজনে  বাবা  মায়ের  নামে  শপথ  করি  একথা  পৃথিবীর  আর  কেউই  জানবেনা  | আমরা  এই  ডাইরী আজই পুড়িয়ে  ফেলবো  দুজনে  মিলে | তুইই  তো  বাবার  যোগ্য  সন্তান  | আমাদের  বাবা  ডাক্তার  ছিলেন  তুইও  ডাক্তার  হয়েছিস  | আর  বড়  দিদি  হয়ে  আমায়  সম্প্রদান  করে  বাবার  মত  কাজ  করেছিস  | মা  মৃত্যুর  আগে  তোর  কাছ  থেকে  জল  চেয়ে  খেয়েছেন  | এর  পরেও  বলবি  তুই  আমার  রক্তের  সম্পর্কের  কেউ  নয়  ?আমাদের  দুই  বোনকে  মা  কোনদিনও  ভালোবাসায়  কখনো  কার্পণ্য  করেননি  বা  আলাদা  চোখে  দেখেননি  | আমার  তো  মনে  হয়  মা  তোকে  আমার  থেকে  একটু  বেশি  ভালোবাসতেন  | ওই  যে  তুই  ছিলি  লেখাপড়ায়  সেরা  |
 এতক্ষণ রেশমি  কেঁদেই  চলেছিল  | এবার  হেসে  দিয়ে  বললো  ,
-- হিংসুটে  কোথাকার  |
--- চল  দিদি  আজই এক্ষুনি ছন্দার  বাবা  অফিস  থেকে  ফেরার  আগেই  আমাদের  অভিশপ্ত  অতীতের   এই  ডাইরী আমরা  পুড়িয়ে  ফেলি  | 
  দুইবোনে  ডাইরী আর  একটা  দেয়াশলাই  নিয়ে  ছাদের সিঁড়ির  দিকে  এগিয়ে  গেলো  |