অচেনা ফোনকল
নন্দা মুখার্জী রায় চৌধুরী
গতকাল থেকেই কাবেরী ঠিক করে রেখেছিলো আজ দেবেশ অফিস বেরোলেই সে শপিং করতে বেরোবে।কিন্তু হঠাৎ করেই কলোমেঘে চারিদিকে ছেয়ে গেলো।একটু পরেই ঝমঝম করে বৃষ্টি।মন খারাপ নিয়েই জানলাগুলো বন্ধ করতে করতে ভাবলো যাকগে ঈশ্বর যা করেন মঙ্গলের জন্যই করেন।অনেকদিন কিছু লেখা হয়না আজ একটু পুরনো ডায়রীটা খুলে নিয়ে বসি , দেখি কিছু লেখা আসে কিনা।
দেবেশের গল্প,কবিতা পড়ার প্রতি ভীষন ঝোঁক।বিশাল দোতলা বাড়ির উপরের হলঘরটিকে ছোটখাটো একটা লাইব্রেরী করে ফেলেছে।সময় পেলেই দেবেশ ও কাবেরী এই ঘরটিতেই এসে বসে।দুজনে দুটি বই মুখের সামনে নিয়ে ঘণ্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে দেয়।গল্প দু'জনের মধ্যে হয় ডিনার টেবিলে আর রাতে শুতে গিয়ে।এইভাবেই দুজনে অভ্যস্ত।
ডায়রীটা খুলে নিয়ে বসে কাবেরী।বহু পুরনো লেখার মাঝে অন্যের লেখা তার ডায়রীর প্রথম পাতায় সুন্দর করে একটা আল্পনা আঁকা আর তার নীচে লেখা,'তোমার খাতার প্রথম পাতায় একে দিলাম এক আল্পনা,আমার ছবি কইবে কথা যখন আমি থাকবোনা।'লেখাটার দিকে তাকিয়ে কাবেরী ভীষন অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে।
কলেজের প্রথম দিন কাবেরী যখন কলেজে ঢোকে,আগেরদিন রাতে প্রচুর বৃষ্টি হওয়ায় কিছু কিছু জায়গায় কলেজ চত্বরে জল থাকার ফলে পা পিছলে একদম ধপাস।সবাই যখন খুব হাসছে ঠিক তখনই একটি ছেলে এগিয়ে এসে কাবেরীর হাত ধরে টেনে তোলে।জানতে চায় কোথাও লেগেছে কিনা।সেই প্রথম আলাপ।অনিরুদ্ধ তখন তৃতীয় বর্ষ। তারপর একটু একটু করে বন্ধুত্ব।অনিরুদ্ধ খুব সুন্দর কবিতা লিখতো।বাংলায় অনার্স করছিলো।বিদ্রোহী কবির ' অভিশাপ' কবিতাটা কলেজ সোশ্যালে আবৃত্তি করে অনেকেরই চোখ ভিজিয়ে দিয়েছিলো।এই কবিতার পরিপেক্ষিতে সে একটি কবিতা লিখেছিলো।একদিন একাএকা কলেজের বিশাল বটগাছটার নীচে বসে আছে দেখে কাবেরী এগিয়ে গিয়ে জানতে চাইলো,' কি করছো রুদ্রদা?' রুদ্র হেসে পড়ে বললো,কটা লাইন লিখলাম।'বলে একটা কাগজ এগিয়ে দেয় তার দিকে।তারপর বলে,'কি শিরোনাম দিই বলো তো?'কাগজটা খুলে কাবেরী পড়তে শুরু করে'
আমায় কি পড়বে মনে?
যখন আমি থাকবো না-
হারিয়ে যাবো অচিন দেশে,
একটুও কি কাঁদবে না?
টুকরো টুকরো স্মৃতিগুলো,
চোখের সামনে ভাসবে,
সবই থাকবে আগের মত,
আমায় কি খুঁজবে?
রাগ-অনুরাগ, মান-অভিমান,
সবই থাকবে পড়ে,
আমিই কাছে থাকবো নাগো,
যাবো অনেক দূরে-----।
কাবেরীর ভাবনায় ছেদ পড়ে হঠাৎ ল্যান্ডলাইনের ক্রীং ক্রীং আওয়াজে।কাবেরী মনেমনে ভাবে এই সেই ফোন শুধু দীর্ঘশ্বাস ছাড়া কিছুই শোনা যাবেনা।কিন্তু তবুও কি এক অমোঘ আকর্ষণে ফোনটা আসলেই সব কাজ ফেলে ছুটে চলে যায় কাবেরী।দৌড়ে গিয়ে ফোনটা ধরে।'হ্যালো হ্যালো' কয়েকবার বলার পরেও কোন সারাশব্দ অপর প্রান্ত থেকে পায়না।রিসিভারটা কান থেকে নামাতে যাবে হঠাৎ শোনে,'কেমন আছো?' 'ভালো আছি কিন্তু কে বলছেন বুঝতে পারছিনা'।কাবেরী বলে,'আপনি প্রায়ই ফোন করেন কিন্তু কোন কথা বলেননা কেন?' প্রতিদিনের মত একটি দীর্ঘশ্বাস কানে আসে কাবেরীর তারপরেই অপর প্রান্ত থেকে ফোনটা রেখে দেওয়ার শব্দ।দেবেশ বাড়িতে না থাকলেই বেশ কিছুদিন ধরেই এই ফোনকলটা আসছে কিন্তু কিছুই বলেননা ভদ্রলোক।গলাটা খুব ভারী হলেও মনেহয় তার এ গলা যেন চেনা।কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারেনা ফোনের অপরপ্রান্তে যে ছিলো সে কে?
বৃষ্টিটা এতক্ষণে কমেছে।আজ আর বেরোনো হবেনা বুঝতে পেরে ঘরের ফার্নিচারগুলো একটু ঝাড়পোছ করতে শুরু করে।স্নানটা সকালেই সেরে নিয়েছিলো।এই কাজগুলি করতে গিয়ে আবারও তাকে একপোস্ত স্নান করতে হল । দুপুরে খেয়েদেয়ে শোবার ঘরে ঢুকে দেখে ডায়রীটা সেইভাবেই পড়ে আছে।ফোনের আওয়াজ শুনে সেই যে বেডরুম থেকে বেরিয়েছিলো তারপর আর তো এখানে আ পাশ করে বেরিয়ে যাওয়ার পড়ে প্রায় প্রতিদিনই সে কাবেরীর সাথে দেখা করতে কলেজগেটে এসে হাজির হত।কোনদিন কোন ফাঁকা জায়গায় বা কোন কফিবারে বসে দুজনে অনেকটা সময় গল্প,হাসি,ঠাট্টা,মান-অভিমানে কাছাকাছি কাটিয়েছে।
কাবেরীর বাবা ছিলেন একজিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার।হঠাৎ করেই তার ট্রান্সফার হয়ে যায়।সেই সময়ে মুঠো ফোনের ফোনের এতো দৌরত্বও ছিলোনা।কিছুদিন ধরেই অনিরুদ্ধ কাবেরীকে বলছিলো বীরভূমের একটি কলেজে তার চাকরীর কথা হচ্ছে সেখানে যেতে হবে।কিন্তু কবে যাবে এখনও ঠিক হয়নি।কদিন ধরেই সে কলেজে কাবেরীর সাথে দেখা করতে আসছেনা।এদিকে বাবার চাকরীর বদলী।অনিরুদ্ধ কাকু,কাকিমার কাছে মানুষ।তারা থাকেন গ্রামে।সে একটা মেসে থাকতো।কাবেরী অনেক খুঁজে সেই মেসেও গেছিলো কিন্তু কেউ কিছুই বলতে পারেনি।নিরুপায় হয়ে ফিরে এসেছে।তখন কাবেরীর থার্ড ইয়ার।এই অবস্থায় অন্য কোন কলেজে সে চেষ্টা করেও ভর্তি হতে পারবেনা মনে করে কাবেরী ও ওর মাকে রেখে কাবেরীর বাবা জামশেদপুর চলে যান।এদিকে অনিরুদ্ধর খবরের জন্য কাবেরী ভীষণ উতলা হয়ে পড়ে।
রুদ্রদার কথা ভাবতে ভাবতে আজও কাবেরী একটা লাইনও লিখতে পারলোনা।কবিতা পড়া বা লেখার নেশা ধরিয়েছিলো অনিরুদ্ধই তাকে।আজ এতগুলো বছর বাদে ওই ডায়রীটাই তাকে ফেলে আসা অতীতে নিয়ে গেছে।অনার্স কমপ্লিট করার আগে থাকতেই অনিরুদ্ধ প্রচুর টিউশনি করতো।বলতে গেলে নিজের খরচ সে নিজেই চালাতো।কারন দরিদ্র কাকু,কাকিমার ক্ষমতা ছিলোনা তাকে কলকাতা রেখে পড়াশুনা করানোর।তাদের নিজেদের দুটি সন্তান রয়েছে।বাবা জম্মের আগেই মারা গেছেন আর অনিরুদ্ধর যখন পাঁচ বছর বয়স তখন মা চিরতরে চলে গেছেন।কাকু,কাকিমা তার জন্য যথাসাধ্য করেছেন।তাদের অন্য দুই সন্তানের থেকে কখনোই তাকে আলাদা করে দেখেননি।কাকু,কাকিমার প্রতি অনিরুদ্ধর ছিলো অসীম শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।এসব কথা নানান কথাচ্ছলে অনিরুদ্ধ কাবেরীকে বলেছে।ভীষণ দায়িত্ব ও কর্তব্যপরায়ণ মানুষটা এইভাবে হঠাৎ কিছু না বলে কোথায় হারিয়ে গেলো কাবেরী ভেবে কোন কূল কিনারা পায়না।
রাতে খাবার টেবিলে কাবেরী আজ দেবেশকে এই অদ্ভুত ফোনকলের কথাটা বলেই ফেলে।আজ তো প্রথম নয় এর আগেও বেশ কয়েকবার এরূপ কল এসছে।অপরপ্রান্ত থেকে শুধু দীর্ঘশ্বাস ছাড়া কিছুই কাবেরী শুনতে পায়না।আজ তো তবুও 'কেমন আছো কথাটা জানতে চেয়েছে।'
---নিশ্চয় তোমার পরিচিত কোন লোক হবে।তা নাহলে 'কেমন আছো জানতে চাইবে কেন?
--এর আগেও বেশ কয়েকবার এই কলটা এসছে জানো?কিন্তু কিছুই বলেনা।আজ তো তবুও একটা কথা বলেছে।
---আরে ছাড়ো তো।খেয়েদেয়ে কাজ না থাকলে মানুষ তখন ওই আননোন নম্বরে ফোন করে টাইম পাস করে।
---কিন্তু ফোনটা তো তখনই আসে যখন তুমি বাড়ি থাকোনা।
---তাহলে আশেপাশের কেউ হবে হয়তো। তানাহলে সে জানবে কেমন করে আমি কখন আসছি বা কখন বেড়চ্ছি।এসব নিয়ে মাথা ঘামিও না।
দেবেশ ব্যাপারটাকে হালকা করার চেষ্টা করে।কিন্তু কাবেরীর মন থেকে খুঁতখুঁতানি যায়না।
অনিরুদ্ধর খবর না পেয়ে পাগলের মত তার পরিচিত বন্ধু বান্ধব মহলে খুঁজে বেরিয়েছে কাবেরী।কিন্তু কেউই তার কোন সন্ধান দিতে পারেনি।একদিন অন্যমনস্কভাবে রাস্তা পার হতে গিয়ে কাবেরী মারাত্মকভাবে এ্যাকসিডেন্ট করে।দুটো চোখের মধ্যেই অদ্ভুতভাবে কাঁচ ঢুকে তাকে চিরতরে অন্ধ করে দেয়।খবর পেয়ে তার বাবা ছুটে আসেন।মাথায় প্রচণ্ড আঘাত পায়।হাসপাতালে তিনদিন কোন জ্ঞানই ছিলোনা।তিনদিন পরে কাবেরী যখন চোখ খোলে তখন তার সামনে শুধু অন্ধকার!প্রচুর ছুটোছুটি, দৌড়াদৌড়ির পর ডক্টর জানালেন আই ব্যাঙ্কে যোগাযোগ করতে।একমাত্র চোখ প্রতিস্থাপন ছাড়া কাবেরীর দৃষ্টি ফেরানো সম্ভব নয়।তখন শুরু হোল বাড়ির লোকের আই ব্যাঙ্কের সামনে হোত্যে দিয়ে পড়ে থাকা।দিন পনের বাদে দুটি চোখই পাওয়া গেলো।কাবেরী তার দৃষ্টি পূনরায় ফিরে পেলো।
কাবেরী তার বাবার কাছে পরে জেনেছে একটি চব্বিশ পঁচিশ বছরের ছেলে মারাত্মকভাবে এ্যাকসিডেন্ট করে তিনমাস যাবত জ্ঞানহীন অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি ছিলো।কোন আত্মীয়স্বজন কোনদিন তাকে দেখতে আসেনি।তিনমাস পরে যখন তার জ্ঞান আসে সে বুঝতে পারে তার দুটো পা ই কেটে বাদ দিতে হয়েছে।দিনরাত হাসপাতালের বেডে শুয়ে কান্নাকাটি করতো।তারপর একদিন একজন জুনিয়র ডাক্তারকে ডেকে সে তার শরীরের সমস্ত অঙ্গগুলি দানে অঙ্গীকার বদ্ধ হয়।সুস্থ্য হয়ে ক্রাচে ভর করে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে যায়।কিছুদিন পরে পুণরায় সেই হাসপাতালে এসেই চারতলা থেকে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করে।
কথাগুলো ভাবতে ভাবতে কাবেরী দেবেশের জন্য জলখাবার তৈরী করছিলো।ফোনের আওয়াজ শুনে হাতটা আঁচলে মুছে ফোনটা এসে ধরে।সেই ফোন।অপর প্রান্ত থেকে কোন সাড়া নেই।কাবেরী একটু বিরক্ত হয়েই আজ বলে,
---ফোন করে যখন কোন কথায় বলেননা তখন রোজ রোজ কেন ফোন করেন?কে আপনি?কি প্রয়োজনে ফোন করেন?আজ আপনাকে বলতেই হবে কেন রোজ রোজ আমায় ফোন করে এভাবে বিরক্ত করছেন?
---রোজই তো বলতে চাই কিন্তু বলতে পারিনা কবরী।(অনিরুদ্ধ এই নামেই কাবেরীকে ডাকতো।)
---কে?? কে আপনি ? ?
---সত্যিই কি চিনতে পারছো না কবরী?
---রুদ্রদা?কোথায় ছিলে এতদিন?তারমানে রোজ তুমিই ফোন করতে?তবে কথা বলতে না কেন?আমার অপারেশানের পর সুস্থ্য হয়ে বাড়ি ফেরার পর থেকেই তোমার ফোন আসতো।কিন্তু কোনদিনও তুমি কথা বলোনি?কেন রুদ্রদা কেন?কি অপরাধ করেছিলাম আমি?কাউকে কিচ্ছুটি না বলে কেন উধাও হয়ে গেলে?কান্নায় ভেঙ্গে পরে কাবেরী।
---বলবো বলেই তো ফোন করি।কিন্তু কোনদিনও আর বলা হয়ে ওঠেনা।আজ তোমায় সব বলবো । শোনো তবে ---
যেদিন তোমার সাথে আমার শেষ দেখা হোল সেদিন বাড়ি ফিরে দেখলাম কলেজের চাকরীটা আমার হয়ে গেছে। পরদিনই জয়েনিং।তোমাকে খবর দেওয়ার কোন সময়ই পাইনি।ভেবেছিলাম চাকরিতে জয়েন করে পরে এসে তোমায় চমকে দেবো।আমি চাকরিতে জয়েন করলাম।দিন পনের বাদে এক শনিবারে কলেজ শেষে বেরিয়ে কাকু,কাকিমার সাথে দেখা করে আমি কলকাতার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।কিন্তু ভাগ্য আমার কোনদিনও সহায় ছিলোনা আমি জানতাম।কিন্তু চাকরীটা পেয়ে সে ধারণা আমার একটু একটু করে পরিবর্তন হচ্ছিলো।তো যা বলছিলাম---কলকাতা আসতে গিয়ে আমি মারাত্মকভাবে এ্যাকসিডেন্ট করি।পথচারীরাই আমাকে হাসপাতাল ভর্তি করে।তিনমাস অজ্ঞান অবস্থায় ছিলাম।জ্ঞান ফিরলে বুঝতে পারি আমি আর জীবনেও নিজের পায়ে ভর দিয়ে হাঁটতে পারবোনা।আমার জীবনের সমস্ত আশা, আকাঙ্খা সব শেষ হয়ে গেলো বুঝতে পেরেই নিজেকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে নিলাম।এইভাবে বেঁচে থাকা মানে সারাটা জীবন অন্যের উপর নির্ভর করে চলা। এর পরের ঘটনা তো তোমার জানা।
ফোনটা কেটে গেলো।কাবেরী কাঁদতে কাঁদতে বার কয়েক হ্যালো হ্যালো করলো কিন্তু অপর প্রান্ত থেকে আজ সে আর কোন দীর্ঘশ্বাস শুনতে পেলোনা।কাঁদতে কাঁদতে নিজের অজান্তেই চোখদুটিতে হাত বুলাতে লাগলো।আর মনেমনে বলতে লাগলো,'রুদ্রদা তোমার চোখ দিয়েই পৃথিবীটাকে নূতনভাবে দেখছি।ভুল বুঝেছিলাম তোমায়।ভেবেছিলাম তুমি আমায় ঠকিয়েছো।কিন্তু তুমি তো আমায় নূতন জীবন দান করেছো।এইভাবেই তুমি তোমার জীবনের নাবলা কথাগুলো আমায় জানিয়ে না গেলে আমি তো সারাজীবনই তোমায় ভুল বুঝেই থাকতাম।আমাকে ক্ষমা কোরো রুদ্রদা,আমায় ক্ষমা কোরো।'