Saturday, August 31, 2019

জীবনের স্মৃতি

জীবনের স্মৃতি
         নন্দা মুখার্জী রায় চৌধুরী

কিছু মুহূর্ত আর কিছু শব্দ
পিছনে ফেলে এসেছি,
যেগুলো আজ শুধুই স্মৃতি।

সিনেমার ফ্লাশব্যাকের মত
মুহূর্তরা সামনে আসে,
শব্দগুলো আজও মনে দেয় দোলা,
আজ তারা জীবনের অথিতি।

ভাবনার সাথে বাস্তবের আজ মিল নেই
স্বপ্ন দেখতে আজ আর ভালো লাগেনা,
সমুদ্রের অহরহ ঢেউগুলির মত,
শব্দ আর মুহূর্তরা আঘাত হানে।

জীবন থেকে অনেকটা সময় চলে গেছে
সময়ের মূল্য তখন বুঝিনি,
হারিয়ে যাওয়া মুহূর্তগুলিকে প্রতিনিয়ত ফিরে পেতে চাই,
অব্যক্ত যন্ত্রণা আর শিশিরে ভেজা ভালোবাসা,
বয়ে চলেছি শুধু মনে মনে।

       30-8-19   12AM





Wednesday, August 21, 2019

চিরকুট

চিরকুট

ফুলের সুগন্ধে সবাই মোহিত,
কিছু তো গুণ আমারও আছে---
আমি কেন অনাদরিত?
ফুলের কাঁটা আঘাত করে,
তবুও ভালোবাসা সে পায়।
আমি উজাড় করে ভালোবাসি---
বিশ্বাসে ঠকি,অন্যের আঘাত নিয়ে বাঁচি,
কেন তবে কাছের মানুষ দূরে সরে যায়? 

Monday, August 19, 2019

জীবনতরী একতারেতেই বাঁধা

জীবনতরী একতারেতেই বাঁধা
  নন্দা মুখার্জী রায় চৌধুরী

     শহরের নামকরা বৃদ্ধাআশ্রম।এখানে বয়স্ক নারী পুরুষ একই ছাদের তলায় শুধু রুমগুলিই যা আলাদা।সুবিধা সর্বরকম।খাওয়াদাওয়া, নানান স্থানে তাদের নিয়ে ঘুরে বেড়ানো ;যারফলে অন্যান্য বৃদ্ধাআশ্রমগুলি থেকে এখানে খরচটা একটু বেশিই।এখনকার বয়স্ক বয়স্করা তাদের ছেলেমেয়েদের এতো বড় মানুষ তৈরী করেছেন যে তারা তাদের পিতামাতাকে বেশ আদরযত্ন পাওয়ার জন্য অর্থের কথা মোটেই ভাবেননি!
এখানে আশ্রিতদের ছেলেমেয়েরা সকলেই অর্থের বিনিময়ে সংসারে সুখ শান্তি কিনেছেন।খেয়ে না খেয়ে,নিজেদের শখআহ্লাদ বিসর্জন দিয়ে নিজেদের সন্তানকে মোটা অংকের টাকা উপার্জনক্ষম করে বড় করেছেন কিন্তু এদের কাউকেই মানুষের মত মানুষ করতে পারেননি!
   চন্দ্রনাথ ব্যানার্জি।এই আশ্রমের প্রধান।বয়স মাত্র আটান্ন বৎসর।চাকরী জীবন থেকে স্বেচ্ছাবসর নিয়েছেন।চাকুরী করতেন বিশাল মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানীর উচ্চপদে।সংসার তার জীবনে আর হয়নি।বলা ভালো জীবনে একজনকে  ভালোবেসে তাকে না পেয়ে আর কাউকেই সেই জায়গাটা দিতে পারেননি।
     গ্রামের স্কুল জীবন শেষ করে কলকাতায় কম্পিউটার সায়েন্স নিয়ে কলেজে যখন ভর্তি হয় চন্দ্রনাথ তখনও তার গ্রাম্য সরলতার কারনে অধিকাংশ সময় মানুষ চিনতে ভুল করেছে ও নানান কারনে অন্যের দ্বারা অপমানিত ও অসম্মাননিত হয়েছে।পড়াশুনায় তুখোড় চন্দ্রনাথ কলেজের প্রত্যেক অধ্যাপকের ছিলো প্রিয়পাত্র।কিন্তু হোষ্টেলের ছাত্রদের সাথে কখনোই তার সরলতা দিয়ে তাদের ছলচাতুরীকে জয় করতে পারেনি।একই রুমে ছিলো চারজন।অধিকাংশ দিনই তার বিছানার চাদর থাকতো মেঝেতে,বই থাকতো অন্যের টেবিলে,তার কলম সে খুঁজে পেতোনা।কিন্তু মুখ ফুটে কোনদিনই সে কাউকেই কিছু বলেনি।পড়াশুনায় ব্যাঘাত ঘটাতে তারা ছিলো ওস্তাদ।একবার ছুটিতে গ্রামের বাড়িতে ফিরে গিয়ে বাবাকে সবকথা জানাতেই স্কুল শিক্ষক বাবা কলকাতায় তার এক বাল্যবন্ধুআর বাড়িতে তাকে পেয়িংগেষ্ট রাখেন।
   বাদল চৌধুরীর একমাত্র মেয়ে অনুরাধা।রূপে গুণে জুড়ি মেলা ভার।তখন সবে মাধ্যমিক দিয়েছে।চন্দ্রনাথ তাকে দেখলেই কেমন জড়সড় হয়ে যেতো।অনুরাধা কিছু জিজ্ঞাসা করলে বেশিরভাগ সময় মাথা নাড়িয়ে বা হ্যাঁ না তেই উত্তর দিতো।দোতলা বাড়ির উপর তলাতে থাকতেন ব্যাঙ্ককর্মী বাদল চৌধুরী,তার স্ত্রী আর একমাত্র মেয়ে অনুরাধা।শুধু খাবার সময়েই বাদলবাবুর স্ত্রী মনোরমা একটি বেল বাজিয়ে চন্দ্রনাথকে ডাকতেন।মনোরমাদেবী চন্দ্রনাথকে খুবই ভালোবাসতেন।উনি নিজেও ছিলেন গ্রামের মেয়ে।চন্দ্রনাথের সরলতায় মনোরমাদেবী মুগ্ধ হয়েছিলেন।সময় পেলেই গ্রামের সবুজ ধানক্ষেত,আমবাগান,লিচু পেয়ারা বাগান নিয়ে পুত্রসম চন্দ্রের সাথে ঘণ্টার পর ঘন্টা গল্প করে চলতেন।মাঝে মাঝে অনুরাধা এসে হাজির হলে চন্দ্রনাথ তখন শ্রোতার ভূমিকা গ্রহণ করতো।অনুরাধাকে দেখলেই চন্দ্রনাথ কেমন খোলসের ভিতর নিজেকে গুটিয়ে নিতো।কিছুতেই সে অনুরাধার সামনে ফ্রী হতে পারতোনা।কিন্তু বাদলবাবু চন্দ্রকে আটকে তার স্ত্রীর এই গল্প করাটাকে কিছুতেই মানতে পারতেন না।তার অবশ্য অন্য কারন আছে।এখানে থেকে বাল্যবন্ধুর ছেলের পড়াশুনার ক্ষতি হোক তিনি তা কিছুতেই চাইতেননা।চন্দ্রনাথের বাবা যখন ফোন করে বন্ধুকে এই ব্যপারে সাহায্য করতে বলেন বন্ধু বাদলবাবু বলেন,
--আরে তোর ছেলে কি আমারও ছেলে নয়?তুই নিশ্চিন্ত মনে ওকে পাঠিয়ে দে আমার কাছেই ও থাকবে।আর শোন,টাকাপয়সার কথা একদম বলবিনা। গ্রামে যখন আমরা একসাথে থাকতাম তখন তোর আমার দু'বাড়িতেই আমাদের জন্য রান্না হোত।যেদিন যে বাড়ি ইচ্ছা হোত স্কুল থেকে ফিরে সেই বাড়িতেই খেতাম।কথাগুলো বলেই হা হা করে হাসতে থাকেন বাদলবাবু।
     চন্দ্রনাথের যখন লাষ্ট ইয়ার তখন ক্যাম্পাস থেকেই মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানীতে মোটা অঙ্কের বেতনের চাকরী হয়ে যায়।কলেজ থেকে ফেরার আগেই বাবাকে স্কুলে ফোন করে জানায়।অনুরাধাদের বাড়িতে ফিরেই সেই জামা কাপড় পরেই দৌড়ে উপরে উঠতে গিয়ে অনুরাধার সাথে একদম সামনাসামনি ধাক্কা।অনুরাধা তাল সামলাতে না পেরে পিছনের দেওয়ালের দিকে পড়ে যেতে গেলে চন্দ্রনাথ খপ করে অনুরাধার একটি হাত ধরে টান দেয়।পিছন ঘূরেই অনুরাধা একদম চন্দ্রনাথের বুকের উপর।ঘটনার আকস্মিকতায় দু'জনে কিছুটা সময় ওই ভাবেই দাঁড়িয়ে থাকে।কিছুক্ষণ পর নিজেদের মুক্ত করে চন্দ্র মাথা নীচু করে বেরিয়ে যেতে যায়।তখন তার বুকের মধ্যে ঠকঠক করে কাঁপছে।পা দুটো যেন অসার।অনুরাধার কথায় পিছন ফেরে--
---কিছু না বলেই চলে যাচ্ছেন যে?কি বলতে এসেছিলেন বললেন না তো?তবে মা,বাবা এখন বাড়িতে নেই।আমাকে বললে হবে?
---আচ্ছা আমি পড়ে আসবো।
--কিন্তু আমার যে একটা কথা বলার ছিলো।
চন্দ্রনাথ দাঁড়িয়ে পড়ে।মুখটা নীচুর দিকেই থাকে।
--এই দেখুন আপনার সাথে কথা বলছি আর আপনি মুখটা নীচু করেই আছেন। আমার মুখের দিকে তাকান।
চন্দ্র আস্তে আস্তে মুখ তুলে অনুরাধার দিকে তাকায়।
---আমার চোখে চোখ রেখে দেখুন তো আমি যা বলতে চাই তা আপনি বুঝতে পারেন কিনা।
চন্দ্রনাথ লাজুক হেসে বলে,'পারি।'
    পরীক্ষা শেষে দিনসাতেকের জন্য চন্দ্রনাথ গ্রামের বাড়িতে চলে যায়।যাওয়ার আগে অনুরাধার সাথে আলাদাভাবে কোন কথা আর হয়না।অনুরাধার তখনও গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট হয়নি।বাদলবাবু ও তার স্ত্রী চন্দ্রনাথকে যাওয়ার সময় বারবার করে বলে দেন,অফিসে প্রথমদিন যাতে সে এই বাড়ি থেকেই যায়।সেও সম্মতিসূচক ঘাড় নেড়ে বেরিয়ে আসে।গেটের বাইরে এসে ছাদের দিকে তাকিয়ে দেখে অনুরাধা হাত নাড়ছে।অনুরাধা ইশারায় তাকে কিছু বলতে চাইছে।কিন্তু শতচেষ্টা করেও চন্দ্রনাথ অনুরাধার ইশারা বুঝতে পারেনা।
    বাড়িতে কয়েকটা দিন খুব আনন্দ,উল্লাসের মধ্যে কেটে যায়।কিন্তু এর ভিতরেও বারবার তার অনুরাধার কথা মনে হয়েছে।কলকাতা ফেরার আগেরদিন রাতে বাবা বললেন, 'এবার একটা ছোটখাটো ঘর ভাড়া নিয়ে সেখানে উঠে যেতে।বাল্যবন্ধু বাদল যা করেছেন তার ঋণ এ জীবনে শোধ হবার নয়।আর ঋণের বোঝা বাড়িয়ে কাজ নেই।যেভাবে হোক একটা ঘর ভাড়া করে উঠে যেও।'
   দু , একদিন অনুরাধাদের বাড়ির থেকে অফিস করে কলিগদের সহায়তায় একটা ছোট বাড়ি ভাড়া নিয়ে চন্দ্রনাথ সেখানে উঠে যায়।চলে যাওয়ার সময় একটু সুযোগ করে  অনুরাধাকে কথা দিয়ে যায় একটু গুছিয়ে নিয়েই বাবা,মাকে দিয়ে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাবে।ছলছল চোখে অনুরাধা চন্দ্রনাথের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে,অনেককিছু বলার ইচ্ছা থাকলেও কিছুই বলতে পারেনা।
    চন্দ্রনাথ ব্যানার্জীর এই আশ্রমের নাম ' রাধানাথ আশ্রম'।প্রায় রোজই কেউ না কেউ এই আশ্রমের বাসিন্দা হন সম্পূর্ণ অনিচ্ছা সত্বে।যারা তাদের দিতে আসেন সকলের মুখেই থাকে হাসি আর যে বয়স্ক মানুষটা বাসিন্দা হতে আসেন তার চোখে থাকে অবিরাম জলধারা।এদের ছেলেমেয়েরা কেউ কেউ মাঝে মধ্যে কারও কারও সাথে দেখা করতে আসেন।আবার অনেকে মাসের পর মাস বা বছরের পর বছর নিজ সন্তানের মুখ দেখতেই পাননা।এইসব সন্তানদের প্রভাব
প্রতিপত্তি আরও কয়েকধাপ উঁচুতে।কিন্তু টাকার কার্পণ্য তারা করেননা।ধনী ব্যক্তির বাড়িতে পুরনো আসবাবপত্র যেমন রাখেনা অধিকাংশ ধনী পরিবারে এইসব বয়স্ক মানুষগুলো ওই পুরনো আসবাবপত্রের মতই।
   একদিন দুপুর বারোটা।সাতাশ আঠাশ বছরের সুন্দর, সুপুরুষ একটি ছেলে একজন বয়স্ক মহিলার হাত ধরে অফিস রুমে প্রবেশ করে।আজ প্রায় দুদিন ধরে এই যুবকটির সাথে চন্দ্রনাথ বাবুর বার দশেক কথা হয়েছে।যুবকটি পরিচয় দেয় মহিলার মাসতুতো ভাই হিসাবে।চন্দ্রনাথবাবুর সামনে বসেই মহিলা প্রাথমিক টাকার চেকটা লিখে দেন।যুবকটি সমস্ত কাগজপত্র লিখে দিদির স্বাক্ষর করিয়ে সবকিছু চন্দ্রনাথ বাবুর হাতে তুলে দেয়।তিনি অন্য লোক মারফৎ মহিলাকে তারজন্য বরাদ্দ নিদৃষ্ট রুমে পাঠিয়ে দেন।বয়স্কমহিলা চন্দ্রনাথবাবুর দেওয়া লোকটিকে অনুসরণ করেন।যুবকটির কাছে তখন চন্দ্রবাবু মহিলার সম্পর্কে জানতে চান,
---কেন উনি নিজ ইচ্ছায় এই আশ্রমে এলেন?উনার কি কেউই নেই এই পৃথিবীতে?
---আপন বলতে যা বোঝায় সেই অর্থে উনার কেউ নেই।আমিও উনার নিজের কেউ নই।কোন একটি ঘটনার সূত্র ধরে বেশ কয়েকবছর উনার সাথে আমার পরিচয়।দিদি বিয়ে করেননি।একাই থাকতেন।এখন বয়স হয়েছে নানান রোগে ধরেছে।সম্ভবত বছর ত্রিশ আগে দিদির ক্যান্সার হয়েছিলো।তখন মাসিমা,মেসোমশাই বেঁচে ছিলেন।প্রায় ন'মাসের মত চেন্নাই গিয়ে থেকে চিকিৎসা করিয়ে আস্তে আস্তে দিদি সুস্থ্য হন।বর্তমানে ওই রোগ থেকে দিদি সম্পূর্ণ মুক্তি পেয়েছেন।কিন্তু প্রচুর ওষুধ খেতে হয়।তাছাড়া আছে হাইপ্রেসার,সুগার, নার্ভের সমস্যা।এই আশ্রমটার কথা লোকমুখে অনেক শুনেছি।আমিই দিদিকে বললাম এখানে এসে থাকলে দিদি ভালো থাকবেন অনেকের মাঝে।অন্তত দুটো কথা তো বলতে পারবেন  সকলের সাথে।টাকাপয়সা দিদির যা আছে তাতে তার ভালোভাবেই চলে যাবে।আমি মাঝে মাঝে এসে দিদিকে দেখে যাবো।
    যুবকটি বেরিয়ে গেলে চন্দ্রনাথবাবু মহিলার চেকটি হাতে নিয়ে নামটা দেখে চমকে উঠেন।সঙ্গে সঙ্গে তিনি ফর্মটি হাতে নিয়ে ঠিকানাটা দেখে নেন।কিন্তু কি আশ্চর্য তিনি তো অনুরাধাকে দেখে চিনতেই পারেননি।অবশ্য চিনবেনই বা কেমন করে?তিনযুগ আগের দেখা সেই কিশোরী অনুরাধাই যে তার মনের ক্যানভাসে রয়েছে।আর তাছাড়া তিনি তো ভালোভাবে তার মুখের দিকেও তাকিয়ে দেখেননি।সেই বহুকাল আগে যেদিন তিনি বাদলকাকুর বাড়ি থেকে জিনিসপত্র নিয়ে নিজের ভাড়া বাড়িতে চলে আসেন সেদিন অনুরাধা সামনে আসেনি।এমন কি যে কটাদিন তিনি ওই বাড়িতে থেকে অফিস করেছেন অনুরাধা কোন সুযোগই দেয়নি কথা বলার।খুব অভিমান হয়েছিলো তখন।সেই অভিমান নিয়েই প্রায় দু'মাস বাদে যখন আবার অনুরাধাদের বাড়িতে সে গেছিলো তখন বাড়িটা তালাবন্ধ ছিলো।তারপর বহুবার সে ওই বাড়িতে গেছে কিন্তু প্রতিবারই সে তালা দেওয়া দেখেছে।এর মাঝেই অফিস থেকে সুযোগ আসে আমেরিকা যাওয়ার পাঁচ বছরের জন্য।ব্যস,জীবন থেকেই হারিয়ে যায় অনুরাধা।শুধু হৃদয়ে থেকে যায় ভালোবাসাটুকু।
 
    বিকালে এই আশ্রমে চা খাওয়ার পর্বটা চলে সবুজে ঘেরা বিশাল এক বাগানে।সেখানে সিমেন্টে বাঁধানো সারিসারি বসার জায়গা।যারা সেখানে আসতে পারেননা তাদের অবশ্য যার যার ঘরেই চা দিয়ে আসা হয়।চন্দ্রনাথবাবু একবার বাগানে ঢু মেরে সোজা চলে আসেন অনুরাধার রুমে।অনুরাধা তখন জানলার কাছে দাঁড়িয়ে বিশাল আকাশটার দিকে তাকিয়ে হয়তো হারিয়ে যাওয়া ভালোবাসা খুঁজছে।চন্দ্রনাথ আস্তে আস্তে গিয়ে অনুরাধার পিছনে দাঁড়ান।অনুরাধা টের পেয়ে পিছন ফিরে তাকিয়ে বলে,
---আমি সকলের সাথে যাইনি কারন আমি জানতাম চন্দ্রদা তুমি আসবে।
---তুমি আমায় চিনতে পেরেছিলে?
---কেন চিনবো না?তোমার তো কোন পরিবর্তন হয়নি।
---আমি কিন্তু তোমায় চিনতে পারিনি।
ঠোঁটের কোণে ঈষৎ হাসি এনে অনুরাধা বলে,
---তুমি তো ঠিক সেই আগের মত লাজুকই থেকে গেছো!তুমি তো আমার মুখের দিকে একটিবারের জন্যও  তাকাওনি।তাকালে দেখতে পেতে আমি তোমার দিকেই তাকিয়ে ছিলাম।সেই মুহূর্তে পরিচয় দিইনি কারন বিমল ছিলো।বিমল খুব ভালো ছেলে। আমার একটা কঠিন অসুখ হয়েছিলো।বেশ কয়েকমাস আমরা চেন্নাই ছিলাম।সেই সময় ওর বাবাও চেন্নাই এ চিকিৎসা করাতে যেতো। ও তখন খুব ছোট। আমরা একটা বাড়িতে পাশপাশি দুটো ঘরে ভাড়া থাকতাম।সেই থেকে ওর সাথে একটা সুন্দর সম্পর্ক গড়ে উঠেছে।আমি জানতাম কাগজপত্র দেখা হলে তুমি আসবে।আমি ভাবতে পারিনি জানো এখানে এসে তোমার দেখা পাবো।সত্যি বলতে কি এ জীবনে তোমার সাথে আর দেখা হবে তা আমি স্বপ্নেও ভাবিনি।পরীক্ষার পর তুমি যখন গ্রামের বাড়িতে চলে গেলে তার দুদিন পরেই সকালে ঘুম থেকে উঠে হাতে প্রচণ্ড যন্ত্রণা।ডাক্তারের কাছে গিয়ে নানান পরীক্ষানিরীক্ষায় ধরা পড়ে ব্রেস্ট ক্যান্সার।বাবা মোটেই সময় নষ্ট না করে আমায় নিয়ে চেন্নাই চলে এলেন।সাথে মা।এক নাগারে ন'মাস চেন্নাই।এদিকে বাবাও রিটায়ার করলেন।সারাজীবন ধরে সঞ্চিত অর্থ শেষ হয়ে গেলো।বাড়ির নীচের অংশটাও বিক্রি করে দিলেন।এতগুলো মাস পড়ে যখন কলকাতা ফিরে এলাম তখন বাবা আর্থিক দিক থেকে শূন্য।তারপর কখনও তিনমাস কখনো বা ছ'মাস পরে পরে চেকআপে পূনরায় চেন্নাই যেতে হয়।সে এক দুর্বিসহ পরিস্থিতি।এখন পুরোপুরি সুস্থ্য।আস্তে আস্তে মা,বাবা দু'জনেই আমায় ছেড়ে চলে গেলেন। অতো বড় বাড়িতে একা একা একদম ভালো লাগতো না।বিমলই এই আশ্রমটার কথা বললো।ভাগ্যিস ওর কথা শুনে রাজি হয়ে বাড়িটা বিক্রি করে এখানে চলে এসেছি তাই তো তোমার সাথে দেখা হোল।হাসতে থাকে অনুরাধা।এবার তোমার কথা বলো।
---অনেকবার গেছি তোমাদের খোঁজে ওই বাড়িতে।কিন্তু নিরাশ হয়ে ফিরে এসেছি।অফিস থেকে বাইরে পাঠিয়ে দিলো।সেখান থেকে ফিরে বাবা,মাকে নিয়ে কলকাতাতেই থাকতে লাগলাম।দু'বছরের ব্যবধানে মা,বাবা দু'জনেই চলে গেলেন।গ্রামের বাড়িঘর,ধানীজমি,পুকুর সব বিক্রি করে কলকাতা থেকে একটু দূরে কোলাহলহীন এই নির্জনে আমি এই আশ্রম তৈরী করলাম সম্পূর্ণ নিজের টাকায়।বাবা যতদিন বেঁচে ছিলেন তিনিই সংসার সামলেছেন।আমার তো কোন খরচই ছিলোনা।তাই সবকিছু দিয়ে আমার এই আশ্রম।এখানে প্রায় পঞ্চাশজনের মত মানুষ সামান্য অর্থের বিনিময়ে তাদের নিরলস শ্রম দিয়ে সংসার থেকে বিতাড়িত এই বয়স্ক মানুষগুলিকে সেবাযত্ন দিয়ে ভালো রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করে।প্রতিবছর এঁদের সামান্য একটু আনন্দ দিতে দুর্গাপুজোর আয়োজন করে থাকি।এঁরা প্রত্যেকেই কি উৎসাহ,উদ্দীপনা নিয়ে পুজোর আয়োজনে ব্যস্ত থাকেন।এঁদের এই আনন্দ দেখে খুশিতে আমার চোখে জল এসে যায়।আবার কেউ কেউ পুজোর কটাদিন সকলের অলক্ষ্যে নীরবে অশ্রু বিসর্জন দেন ।তখন হয়তো বাড়ির কথা মনে পরে । আমি এইসব নিয়ে বেশ আছি।
কিন্তু অনুরাধা,তোমার তো এই আশ্রমে থাকা হবেনা।
--মানে?আমাকে তুমি আশ্রমে জায়গা দেবেনা?
--এখান থেকে একটু দূরে আমার ছোট্ট একটা বাড়ি আছে।একাই থাকি।তুমি কি পারবে আমার কাছে থাকতে?
--তোমার বৌ,বাচ্চারা এখানে থাকেনা?
  এবার চন্দ্রনাথ হো হো করে হেসে উঠে বললেন,
---সে সুযোগ আর পেলাম কোথায়?যাকে বৌ করবো ভেবেছিলাম সে তো হঠাৎ করেই হারিয়ে গেলো।তাই আর ওপথ মাড়ায়নি।বলে আবারও হেসে উঠলেন।
  তাহলে তুমি রেডি হয়ে নাও,আমি হাতের কাজগুলো সেরে নিই।সন্ধ্যার আগেই আমরা রওনা দেবো।
    জীবন থেকে অনেকগুলো বছর হারিয়ে গেছে ঠিকই কিন্তু বিধাতাপুরুষ যাদের জীবনতরী এক তারেতেই বেঁধে রেখেছেন শেষ বয়সে হলেও দেখা তো তাদের হবেই আর জীবনের বাকি পথটুকুও একসাথেই তারা হাঁটবে।




Tuesday, August 6, 2019

অচেনা ফোনকল

অচেনা ফোনকল
              নন্দা মুখার্জী রায় চৌধুরী

     গতকাল থেকেই কাবেরী ঠিক করে রেখেছিলো আজ দেবেশ অফিস বেরোলেই সে শপিং করতে বেরোবে।কিন্তু হঠাৎ করেই কলোমেঘে চারিদিকে ছেয়ে গেলো।একটু পরেই ঝমঝম করে বৃষ্টি।মন খারাপ নিয়েই জানলাগুলো বন্ধ করতে করতে ভাবলো যাকগে ঈশ্বর যা করেন মঙ্গলের জন্যই করেন।অনেকদিন কিছু লেখা হয়না আজ একটু পুরনো ডায়রীটা খুলে নিয়ে বসি , দেখি কিছু লেখা আসে কিনা।
   দেবেশের গল্প,কবিতা পড়ার প্রতি ভীষন ঝোঁক।বিশাল দোতলা বাড়ির উপরের হলঘরটিকে ছোটখাটো একটা লাইব্রেরী করে ফেলেছে।সময় পেলেই দেবেশ ও কাবেরী এই ঘরটিতেই এসে বসে।দুজনে দুটি বই মুখের সামনে নিয়ে ঘণ্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে দেয়।গল্প দু'জনের মধ্যে হয় ডিনার টেবিলে আর রাতে শুতে গিয়ে।এইভাবেই দুজনে অভ্যস্ত।
   ডায়রীটা খুলে নিয়ে বসে কাবেরী।বহু পুরনো লেখার মাঝে অন্যের লেখা তার ডায়রীর প্রথম পাতায় সুন্দর করে একটা আল্পনা আঁকা আর তার নীচে লেখা,'তোমার খাতার প্রথম পাতায় একে দিলাম এক আল্পনা,আমার ছবি কইবে কথা যখন আমি থাকবোনা।'লেখাটার দিকে তাকিয়ে কাবেরী ভীষন অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে।
কলেজের প্রথম দিন কাবেরী যখন কলেজে ঢোকে,আগেরদিন রাতে প্রচুর বৃষ্টি হওয়ায় কিছু কিছু জায়গায় কলেজ চত্বরে জল থাকার ফলে পা পিছলে একদম ধপাস।সবাই যখন খুব হাসছে ঠিক তখনই একটি ছেলে এগিয়ে এসে কাবেরীর হাত ধরে টেনে তোলে।জানতে চায় কোথাও লেগেছে কিনা।সেই প্রথম আলাপ।অনিরুদ্ধ তখন তৃতীয় বর্ষ। তারপর একটু একটু করে বন্ধুত্ব।অনিরুদ্ধ খুব সুন্দর কবিতা লিখতো।বাংলায় অনার্স করছিলো।বিদ্রোহী কবির ' অভিশাপ' কবিতাটা কলেজ সোশ্যালে আবৃত্তি করে অনেকেরই চোখ ভিজিয়ে দিয়েছিলো।এই কবিতার পরিপেক্ষিতে সে একটি কবিতা লিখেছিলো।একদিন একাএকা কলেজের বিশাল বটগাছটার নীচে বসে আছে দেখে কাবেরী এগিয়ে গিয়ে জানতে চাইলো,' কি করছো রুদ্রদা?' রুদ্র হেসে পড়ে বললো,কটা লাইন লিখলাম।'বলে একটা কাগজ এগিয়ে দেয় তার দিকে।তারপর বলে,'কি শিরোনাম দিই বলো তো?'কাগজটা খুলে কাবেরী পড়তে শুরু করে'

আমায় কি পড়বে মনে?
যখন আমি থাকবো না-
হারিয়ে যাবো অচিন দেশে,
একটুও কি কাঁদবে না?
টুকরো টুকরো স্মৃতিগুলো,
চোখের সামনে ভাসবে,
সবই থাকবে আগের মত,
আমায় কি খুঁজবে?
রাগ-অনুরাগ, মান-অভিমান,
সবই থাকবে পড়ে,
আমিই কাছে থাকবো নাগো,
যাবো অনেক দূরে-----।

       কাবেরীর ভাবনায় ছেদ পড়ে হঠাৎ ল্যান্ডলাইনের ক্রীং ক্রীং আওয়াজে।কাবেরী মনেমনে ভাবে এই সেই ফোন শুধু দীর্ঘশ্বাস ছাড়া কিছুই শোনা যাবেনা।কিন্তু তবুও কি এক অমোঘ আকর্ষণে ফোনটা আসলেই সব কাজ ফেলে ছুটে চলে যায় কাবেরী।দৌড়ে গিয়ে ফোনটা ধরে।'হ্যালো হ্যালো' কয়েকবার বলার পরেও কোন সারাশব্দ অপর প্রান্ত থেকে পায়না।রিসিভারটা কান থেকে নামাতে যাবে হঠাৎ শোনে,'কেমন আছো?' 'ভালো আছি কিন্তু কে বলছেন বুঝতে পারছিনা'।কাবেরী বলে,'আপনি প্রায়ই ফোন করেন কিন্তু কোন কথা বলেননা কেন?' প্রতিদিনের মত একটি দীর্ঘশ্বাস কানে আসে কাবেরীর তারপরেই অপর প্রান্ত থেকে ফোনটা রেখে দেওয়ার শব্দ।দেবেশ বাড়িতে না থাকলেই বেশ  কিছুদিন ধরেই এই ফোনকলটা আসছে কিন্তু কিছুই বলেননা ভদ্রলোক।গলাটা খুব ভারী হলেও মনেহয় তার এ গলা যেন চেনা।কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারেনা ফোনের অপরপ্রান্তে যে  ছিলো সে কে?
   বৃষ্টিটা এতক্ষণে কমেছে।আজ আর বেরোনো হবেনা বুঝতে পেরে ঘরের ফার্নিচারগুলো একটু ঝাড়পোছ করতে শুরু করে।স্নানটা সকালেই সেরে নিয়েছিলো।এই কাজগুলি করতে গিয়ে আবারও তাকে একপোস্ত স্নান করতে হল । দুপুরে খেয়েদেয়ে শোবার ঘরে ঢুকে দেখে ডায়রীটা সেইভাবেই পড়ে আছে।ফোনের আওয়াজ শুনে সেই যে বেডরুম থেকে বেরিয়েছিলো তারপর আর তো এখানে আ পাশ করে বেরিয়ে যাওয়ার পড়ে প্রায় প্রতিদিনই সে কাবেরীর সাথে দেখা করতে কলেজগেটে এসে হাজির হত।কোনদিন কোন ফাঁকা জায়গায় বা কোন কফিবারে বসে দুজনে অনেকটা সময় গল্প,হাসি,ঠাট্টা,মান-অভিমানে কাছাকাছি  কাটিয়েছে।
   কাবেরীর বাবা ছিলেন একজিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার।হঠাৎ করেই তার ট্রান্সফার হয়ে যায়।সেই সময়ে মুঠো ফোনের ফোনের এতো দৌরত্বও ছিলোনা।কিছুদিন ধরেই অনিরুদ্ধ কাবেরীকে বলছিলো বীরভূমের একটি কলেজে তার চাকরীর কথা হচ্ছে সেখানে যেতে হবে।কিন্তু কবে যাবে এখনও ঠিক হয়নি।কদিন ধরেই সে কলেজে কাবেরীর সাথে দেখা করতে আসছেনা।এদিকে বাবার চাকরীর বদলী।অনিরুদ্ধ কাকু,কাকিমার কাছে মানুষ।তারা থাকেন গ্রামে।সে একটা মেসে থাকতো।কাবেরী অনেক খুঁজে সেই মেসেও গেছিলো কিন্তু কেউ কিছুই বলতে পারেনি।নিরুপায় হয়ে ফিরে এসেছে।তখন কাবেরীর থার্ড ইয়ার।এই অবস্থায় অন্য কোন কলেজে সে চেষ্টা করেও ভর্তি হতে পারবেনা মনে করে কাবেরী ও ওর মাকে রেখে কাবেরীর বাবা জামশেদপুর চলে যান।এদিকে অনিরুদ্ধর খবরের জন্য কাবেরী ভীষণ উতলা হয়ে পড়ে।   
    রুদ্রদার কথা ভাবতে ভাবতে আজও  কাবেরী একটা লাইনও লিখতে পারলোনা।কবিতা পড়া বা লেখার নেশা ধরিয়েছিলো অনিরুদ্ধই তাকে।আজ এতগুলো বছর বাদে ওই ডায়রীটাই তাকে ফেলে আসা অতীতে নিয়ে গেছে।অনার্স কমপ্লিট করার আগে থাকতেই অনিরুদ্ধ প্রচুর টিউশনি করতো।বলতে গেলে নিজের খরচ সে নিজেই চালাতো।কারন দরিদ্র কাকু,কাকিমার ক্ষমতা ছিলোনা তাকে কলকাতা রেখে পড়াশুনা করানোর।তাদের নিজেদের দুটি সন্তান রয়েছে।বাবা জম্মের আগেই মারা গেছেন আর অনিরুদ্ধর যখন পাঁচ বছর বয়স তখন মা চিরতরে চলে গেছেন।কাকু,কাকিমা তার জন্য যথাসাধ্য করেছেন।তাদের অন্য দুই সন্তানের থেকে কখনোই তাকে আলাদা করে দেখেননি।কাকু,কাকিমার প্রতি অনিরুদ্ধর ছিলো অসীম শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।এসব কথা নানান কথাচ্ছলে অনিরুদ্ধ কাবেরীকে বলেছে।ভীষণ দায়িত্ব ও কর্তব্যপরায়ণ মানুষটা এইভাবে হঠাৎ কিছু না বলে কোথায় হারিয়ে গেলো কাবেরী ভেবে কোন কূল কিনারা পায়না।
  রাতে খাবার টেবিলে কাবেরী আজ দেবেশকে এই অদ্ভুত ফোনকলের কথাটা বলেই ফেলে।আজ তো প্রথম নয় এর আগেও বেশ কয়েকবার এরূপ কল এসছে।অপরপ্রান্ত থেকে শুধু দীর্ঘশ্বাস ছাড়া কিছুই কাবেরী শুনতে পায়না।আজ তো তবুও 'কেমন আছো কথাটা জানতে চেয়েছে।'
---নিশ্চয় তোমার পরিচিত কোন লোক হবে।তা নাহলে 'কেমন আছো জানতে চাইবে কেন?
--এর আগেও বেশ কয়েকবার এই কলটা এসছে জানো?কিন্তু কিছুই বলেনা।আজ তো তবুও একটা কথা বলেছে।
---আরে ছাড়ো তো।খেয়েদেয়ে কাজ না থাকলে মানুষ তখন ওই আননোন নম্বরে ফোন করে টাইম পাস করে।
---কিন্তু ফোনটা তো তখনই আসে যখন তুমি বাড়ি থাকোনা।
---তাহলে আশেপাশের কেউ হবে হয়তো। তানাহলে সে জানবে কেমন করে আমি কখন আসছি বা কখন বেড়চ্ছি।এসব নিয়ে মাথা ঘামিও না।
দেবেশ ব্যাপারটাকে হালকা করার চেষ্টা করে।কিন্তু কাবেরীর মন থেকে খুঁতখুঁতানি যায়না।
    অনিরুদ্ধর খবর না পেয়ে পাগলের মত তার পরিচিত বন্ধু বান্ধব মহলে খুঁজে বেরিয়েছে কাবেরী।কিন্তু কেউই তার কোন সন্ধান দিতে পারেনি।একদিন অন্যমনস্কভাবে রাস্তা পার হতে গিয়ে কাবেরী মারাত্মকভাবে এ্যাকসিডেন্ট করে।দুটো চোখের মধ্যেই অদ্ভুতভাবে কাঁচ ঢুকে তাকে চিরতরে অন্ধ করে দেয়।খবর পেয়ে তার বাবা ছুটে আসেন।মাথায় প্রচণ্ড আঘাত পায়।হাসপাতালে তিনদিন কোন জ্ঞানই ছিলোনা।তিনদিন পরে কাবেরী যখন চোখ খোলে তখন তার সামনে শুধু অন্ধকার!প্রচুর ছুটোছুটি, দৌড়াদৌড়ির পর ডক্টর জানালেন আই ব্যাঙ্কে যোগাযোগ করতে।একমাত্র চোখ প্রতিস্থাপন ছাড়া কাবেরীর দৃষ্টি ফেরানো সম্ভব নয়।তখন শুরু হোল বাড়ির লোকের আই ব্যাঙ্কের সামনে হোত্যে দিয়ে পড়ে থাকা।দিন পনের বাদে দুটি চোখই পাওয়া গেলো।কাবেরী তার দৃষ্টি পূনরায় ফিরে পেলো।
  কাবেরী তার বাবার কাছে পরে জেনেছে একটি চব্বিশ পঁচিশ বছরের ছেলে মারাত্মকভাবে এ্যাকসিডেন্ট করে তিনমাস যাবত জ্ঞানহীন অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি ছিলো।কোন আত্মীয়স্বজন কোনদিন তাকে দেখতে আসেনি।তিনমাস পরে যখন তার জ্ঞান আসে সে বুঝতে পারে তার দুটো পা ই কেটে বাদ দিতে হয়েছে।দিনরাত হাসপাতালের বেডে শুয়ে কান্নাকাটি করতো।তারপর একদিন একজন জুনিয়র ডাক্তারকে ডেকে সে তার শরীরের সমস্ত অঙ্গগুলি দানে অঙ্গীকার বদ্ধ হয়।সুস্থ্য হয়ে ক্রাচে ভর করে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে যায়।কিছুদিন পরে পুণরায় সেই হাসপাতালে এসেই চারতলা থেকে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করে।
   কথাগুলো ভাবতে ভাবতে কাবেরী দেবেশের জন্য জলখাবার তৈরী করছিলো।ফোনের আওয়াজ শুনে হাতটা আঁচলে মুছে ফোনটা এসে ধরে।সেই ফোন।অপর প্রান্ত থেকে কোন সাড়া নেই।কাবেরী একটু বিরক্ত হয়েই আজ বলে,
---ফোন করে যখন কোন কথায় বলেননা তখন রোজ রোজ কেন ফোন করেন?কে আপনি?কি প্রয়োজনে ফোন করেন?আজ আপনাকে বলতেই হবে কেন রোজ রোজ আমায় ফোন করে এভাবে বিরক্ত করছেন?
 ---রোজই তো বলতে চাই কিন্তু বলতে পারিনা কবরী।(অনিরুদ্ধ এই নামেই কাবেরীকে ডাকতো।)
---কে?? কে আপনি ? ?
---সত্যিই কি চিনতে পারছো না কবরী?
---রুদ্রদা?কোথায় ছিলে এতদিন?তারমানে রোজ তুমিই ফোন করতে?তবে কথা বলতে না কেন?আমার অপারেশানের পর সুস্থ্য হয়ে বাড়ি ফেরার পর থেকেই তোমার ফোন আসতো।কিন্তু কোনদিনও তুমি কথা বলোনি?কেন রুদ্রদা কেন?কি অপরাধ করেছিলাম আমি?কাউকে কিচ্ছুটি না বলে কেন উধাও হয়ে গেলে?কান্নায় ভেঙ্গে পরে কাবেরী।
---বলবো বলেই তো ফোন করি।কিন্তু কোনদিনও আর বলা হয়ে ওঠেনা।আজ তোমায় সব বলবো । শোনো তবে ---
যেদিন তোমার সাথে আমার শেষ দেখা হোল সেদিন বাড়ি ফিরে দেখলাম কলেজের চাকরীটা আমার হয়ে গেছে। পরদিনই জয়েনিং।তোমাকে খবর দেওয়ার কোন সময়ই পাইনি।ভেবেছিলাম চাকরিতে জয়েন করে পরে এসে তোমায় চমকে দেবো।আমি চাকরিতে জয়েন করলাম।দিন পনের বাদে এক শনিবারে কলেজ শেষে বেরিয়ে কাকু,কাকিমার সাথে দেখা করে আমি কলকাতার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।কিন্তু ভাগ্য আমার কোনদিনও সহায় ছিলোনা আমি জানতাম।কিন্তু চাকরীটা পেয়ে সে ধারণা আমার একটু একটু করে পরিবর্তন হচ্ছিলো।তো যা বলছিলাম---কলকাতা আসতে গিয়ে আমি মারাত্মকভাবে এ্যাকসিডেন্ট করি।পথচারীরাই আমাকে হাসপাতাল ভর্তি করে।তিনমাস অজ্ঞান অবস্থায় ছিলাম।জ্ঞান ফিরলে বুঝতে পারি আমি আর জীবনেও নিজের পায়ে ভর দিয়ে হাঁটতে পারবোনা।আমার জীবনের সমস্ত আশা, আকাঙ্খা সব শেষ হয়ে গেলো বুঝতে পেরেই নিজেকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে নিলাম।এইভাবে বেঁচে থাকা মানে সারাটা জীবন অন্যের উপর নির্ভর করে চলা। এর পরের ঘটনা তো তোমার জানা।
  ফোনটা কেটে গেলো।কাবেরী কাঁদতে কাঁদতে বার কয়েক হ্যালো হ্যালো করলো কিন্তু অপর প্রান্ত থেকে আজ সে আর কোন দীর্ঘশ্বাস শুনতে পেলোনা।কাঁদতে কাঁদতে নিজের অজান্তেই চোখদুটিতে হাত বুলাতে লাগলো।আর মনেমনে বলতে  লাগলো,'রুদ্রদা তোমার চোখ দিয়েই পৃথিবীটাকে নূতনভাবে দেখছি।ভুল বুঝেছিলাম তোমায়।ভেবেছিলাম তুমি আমায় ঠকিয়েছো।কিন্তু তুমি তো আমায় নূতন জীবন দান করেছো।এইভাবেই তুমি তোমার জীবনের নাবলা কথাগুলো আমায় জানিয়ে না গেলে আমি তো সারাজীবনই তোমায় ভুল বুঝেই থাকতাম।আমাকে ক্ষমা কোরো রুদ্রদা,আমায় ক্ষমা কোরো।'