Sunday, October 8, 2023

সব গল্প কাল্পনিক নয় ( সংকলন)

    সব লেখা কাল্পনিক নয়


  দুই বিনুনী ঝুলিয়ে স্কুলে যাওয়ার পথে রেখা রোজ ছন্দাদের বাড়ি আসে। দু'জনে একসাথে বাকি পথটা হেঁটে স্কুলে পৌঁছায়। রেখাদের বাড়ি গ্রামে হলেও ভাইবোনেরা সব মফস্বল শহরে ঘরভাড়া নিয়ে থাকে লেখাপড়ার সুবিধার্থে। আর ছন্দার বাবা শহরে একজন নামজাদা উকিল। ছন্দার বাবা সমরেশ চৌধুরী তার ছেলেমেয়ে নিয়ে নিজের বাড়িতেই থাকেন। 
   জমিদার বাড়ির সন্তান হওয়ার সুবাদে গ্রামে প্রচুর জমিজমা, পুকুর, বাগান ইত্যাদি থাকার ফলে সমরেশ বাবুকে প্রতি শনিবার করেই গ্রামে যেতে হয়। সেখানে তাঁর স্ত্রী,মা ও এক মাত্র ছেলে থাকে। সমরেশ বাবুর পরপর বেশ কয়েকটি মেয়ে হওয়ার পর প্রায় মধ্য বয়সে এসে এই পুত্র সন্তানের জন্ম। স্বাভাবিকভাবেই সে সকলের খুব আদরের। আর বয়স যেহেতু এখন তার খুবই কম সে তার মায়ের সাথে গ্রামের বাড়িতেই থাকে।
    রেখার বাবা স্কুল শিক্ষক।তিনি ও তার স্ত্রী গ্রামেই থাকেন। কিন্তু পড়াশুনার সুবিধার্থে তার ছেলেমেয়ে শহরে ঘরভাড়া করে থাকে। রেখা ও ছন্দাদের বাড়ি একই পাড়ার কয়েকটা বাড়ির পর। পড়েও তারা একই ক্লাসে। রেখার দাদার তখন কলেজে প্রথম বর্ষ। দাদা শুভেদু পড়াশুনায় তুখোড়। এক মাথা ঝাঁকড়া চুল, বুদ্ধিদীপ্ত দু'টি চোখ, টানা ভ্রু। গায়ের রং বেশ চাপা।সুদর্শন বলতে যা বোঝায় শুভেন্দু তা কোনদিনও ছিলো না। ছিল তার একটা আলগা চেহারা। কোন মেয়ে প্রথম দর্শনেই তার প্রেমে পড়বে না একথা ঠিক কিন্তু তার মায়াভরা মুখটার মধ্যে এমন কিছু ছিলো, তার সাথে মিশলে কথা বললে তার সরলতা আর ওই মায়াভরা মুখটা মিলে একটা ভালোলাগা কাজ করতো।
   ছন্দা তাকে যে খুব একটা পছন্দ করতো তা নয়। আবার খুব যে একটা অপছন্দ করতো তাও নয়। কিন্তু বিকেল হলেই কী এক অমোঘ টানে ছন্দা ছুটে যেত রেখাদের বাড়িতে। ছন্দা যখনই তাদের বাড়িতে গেছে সে লক্ষ্য করেছে রেখার দাদা শুভেন্দু মাথা গুঁজে বইয়ের টেবিলে বসা। কলেজ থেকে ফিরে এসে শুভেন্দু কিন্তু ওই সময়টা বাড়িতে তার পড়ার টেবিলেই বসে পড়তো কিংবা বলা ভালো পড়ার ভান করে ছন্দাকে লক্ষ্য করতো। বেশ কয়েকবার প্রতিদিনই দু'জনে চোখাচোখি হয়েছে। কিন্তু দু'প্রান্তের দু'জনেই ভালোলাগা কিংবা ভালোবাসার কথা কেউ কাউকেই বলতে পারেনি। হয়ত বলা ভালো ওই বয়সে ওই সময়ে ভালোবাসাটা তারা নিজেরাও বুঝতে পারেনি। কিন্তু বিকেল হলেই শুভেন্দুকে একটিবার চোখের দেখার অদম্য এক শক্তি ছন্দাকে তার বাড়ির দিকে টেনে নিয়ে যেত। আর অদ্ভুতভাবে শুভেন্দুও বিকেলের ওই সময়টুকু কোনদিনও বাড়ির বাইরে পা রাখেনি।
   এমনই একদিন ছন্দা যখন রেখাদের বাড়ি যায় সেই মুহূর্তে রেখা ঘরে না থাকায় ওর দাদার পড়ার টেবিলের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে দেখে শুভেন্দু একমনে একটা ছবি আঁকছে। ছন্দা তার কিছুটা কাছে এগিয়ে গিয়ে বলে,
--- তুমি কী সুন্দর ছবি আঁকো দাদা। আমার একটা ছবি এঁকে দেবে?
 শুভেন্দু চোখ তুলে ছন্দার মুখের দিকে তাকায়। ওই চোখের দিকে তাকিয়ে মুহূর্তে ছন্দার বুকের ভিতর বিদ্যুৎ খেলে যায়। সে চোখ নামিয়ে নেয়। শুভেন্দু সে কথার উত্তর না দিয়ে যে ছবিটা দেখে সে তার খাতার পাতায় ছবি আঁকছিল সেটা ছন্দার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,
-- এই ছবিটা তুমি রাখো। তোমাকে কিন্তু ববিতার মতোই দেখতে।তাই আলাদা করে ছবি আর আঁকতে হবে না।

           ছবিটা ছিলো বাংলাদেশের সিনেমার নায়িকা ববিতার। শুভেন্দু একবার ছবিটার দিকে আর একবার ছন্দার দিকে তাকিয়ে ছন্দার হাতে ছবিটা দিতে দিতে বলে,
-- আসলে তোমার চেহারাটা আর ববিতার চেহারার কোথায় যেন একটা মিল আছে। তাই ববিতাকে সামনে রেখে ছন্দাকে আঁকার চেষ্টা করছিলাম।
 
ছবিটা ছন্দার হাতে দেওয়ার সময় শুভেন্দুর হাতের স্পর্শে ছন্দার বুকের ভিতর আর একবার কেঁপে ওঠে। কিন্তু কিশোরী ছন্দার এ কেঁপে ওঠার মানে বোঝার মত বুদ্ধি তখনো তার হয়নি। এরফলে তার মনের ভিতরে একটা ভয়ের বাতাবরণ তৈরি হয়। সে ওই বাড়িতে যাওয়া বন্ধ করে দেয়। শুভেন্দুকে রোজ একটিবার চোখের দেখার ইচ্ছাকে নিজের মনের বিরুদ্ধে গিয়ে চাপা দিয়ে রাখে।

 এর বেশ কয়েকদিন পরে একদিন স্কুলে রেখা ছন্দাকে বলে,
-- তুই আজ কয়েকদিন আমাদের বাড়িতে যাস না কেন?
ছন্দা কিছুটা সময় চুপ করে থেকে বলে,
--- যাবো আজ 
-- তোর সাথে আমার একটা কথা আছে। কথাটা তোকে আমি বলছি ঠিকই কিন্তু কথাটা আমার নয়। একজনের কথা সে তোকে বলতে লজ্জা পাচ্ছে তাই আমি বলে দিচ্ছি।
 রেখার এই হেয়ালিপূর্ণ কথা ছন্দা কিছুই বুঝতে পারে না। সে রেখার দিকে তাকিয়ে থাকে। রেখা আর কোন ভনিতা না করে সরাসরি বলে,
--- আমার দাদা তোকে ভালোবাসে রে -
 পড়াশুনায় চিরমেধাবী ছন্দা ভবিষ্যতে ডাক্তার হওয়ার ইচ্ছায় পড়াশুনাটাকেই জীবনে প্রাধান্য দিয়ে এসেছে। হঠাৎ করে রেখার মুখে এই কথা শুনে ছন্দা অবাক হয়ে রেখার মুখের দিকে তাকায়। ছন্দার এই তাকানো দেখে রেখা কিছুটা ঘাবড়ে গিয়ে বলে,
-- আমার দাদা কিন্তু ভবিষ্যতে ডাক্তারী কিংবা ইঞ্জিনিয়ারিং লাইনে যাবে।
 শুভেন্দুর স্পর্শে এই যে বুকের ভিতর কেঁপে ওঠা এই যে বিকেল হলেই তাকে দেখার এক অদম্য ইচ্ছা কিশোরী ছন্দা তখনও বুঝে উঠতে পারেনি এটাই ভালোবাসা। বাবার আত্মসম্মান আর নিজের জীবনের স্বপ্ন এই দুইয়ের কারণেই হয়ত সে এ'দিকটা সারা জীবনের মত ঘুম পারিয়ে রাখতে চেয়েছিল। রেখার কথা শুনে তার মুখের দিকে তাকিয়ে শুধু একটা কথাই সে বলেছিলো,
-- ভবিষ্যতে কে কোন লাইনে যাবে তা কি এখনই বলা যায়? 
 রেখা শুধু বিষণ্ণ মনে ছন্দার দিকে তাকিয়ে ছিল। রেখা তার দাদাকে কী বলেছিলো ছন্দা তা কোনদিনও জানতে চায়নি কিন্তু সেদিন রাতেই শুধু নয় ওই ছবিটা যখনই ছন্দা হাতে নেয় আজও সে সেই মানুষটার ছোঁয়া অনুভব করে।
  এই ঘটনার কিছুদিনের মধ্যেই রেখার এক মারত্মক অসুখ হওয়াতে সে গ্রামের বাড়ি মা,বাবার কাছে চলে যায়। স্কুল আসা বন্ধ হয়। অন্য ভাইবোনদেরও পড়াশুনা শেষ হওয়ায় যে যার জায়গায় প্রতিষ্ঠিত হয়ে যে যার মত জীবন কাটাতে থাকে। শহরে শুধু থেকে যায় শুভেন্দু। কিন্তু ওই বাড়িতে নয় অন্য কোথাও।
   স্মৃতির পাতা ঝাপসা হলেও ববিতার ছবিটা ছন্দার জীবনে প্রথম ভালোলাগা,ভালোবাসার স্পর্শ হিসাবে সে অতি যত্ন করে নিজের কাছেই রেখে দেয়। কিন্তু ছন্দা যখন বুঝতে পারে শুভেন্দুকে সে ভালোবেসে ফেলেছিল তখন সে অনেক দেরি করে ফেলেছিল। সেই সময় যখনই সে রাস্তায় বেরোত তার চোখদু'টি ওই মানুষটাকেই খুঁজতো। কিন্তু কোথায় সে? ছন্দার সামনে দাঁড়িয়ে তার মনের খবর না জেনে চিরদিনের মত ছন্দাকে ভুল বুঝে সে যেন ছোট্ট শহরটা থেকেই হারিয়ে গেলো।
  এরপর কেটে গেছে যুগের পর যুগ। হিন্দুদের প্রতি চরম অত্যাচারের বিপর্যয় ভোগান্তি সমরেশ চৌধুরীর পরিবারের উপর মারত্মক আঘাত হানে। চলে আসে ছন্দারা ভারতের মাটিতে। কিশোরী ছন্দা তখন যৌবনে পৌঁছেছে। এই বিপর্যয়ের ভিতরে জন্মভিটে, লাতিত শৈশব, কৈশর সবকিছু ফেলে আসলেও ফেলে আসতে পারেনি ববিতার ছবিটি। প্রথম ভালোলাগার প্রথম ছোঁয়া হিসাবে অতি সযত্নে সে ছবিটি তার সাথে করেই নিয়ে আসে।
 তারপরেও কেটে গেছে বহুযুগ। বিয়ের পরও পুরনো সেই ছবি ছন্দার নতুন অ্যালবামে ঠাঁই পেয়েছে। কিছুতেই সে যুগ যুগ পড়েও শুভেন্দুকে ভুলতে পারেনি।
 
  জীবনে ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন কবে কোথায় যে কিভাবে হারিয়ে গেলো তা ছন্দারও জানা নেই। গতানুগতিকভাবে সংসার জীবনে পাওয়া না পাওয়ার হিসাব করতে করতেই জীবন থেকে ছাপ্পান্নটা বছর পার হয়ে গেছে। কিন্তু আজও মনের কোথাও না কোথাও প্রথম ভালোলাগার মানুষটা সেই আগের মতই রয়ে গেছে। কোথাও যেন একটা অপেক্ষা ছন্দার জীবনে এই বয়সেও কাজ করে।

 এখন এন্ড্রোয়েড ফোনের দৌলতে পৃথিবী আজ হাতের মুঠোই। কিন্তু শুভেন্দু গুপ্তের কোন খোঁজ সে ফেসবুকের কোথাও পায়নি। তার জীবনের না বলা কথাটা বলার জন্য ছন্দা যেন ধনুকভাঙা পণ করে শুভেন্দুর অপেক্ষায় বসেই আছে। খুঁজে চলেছে ফেসবুকও।

 কী করেই বা সে শুভেন্দু গুপ্তকে পাবে? শুভেন্দু আজ নামকরা একজন ডাক্তার। তার নামের আগে জ্বলজ্বল করে ডাক্তার শব্দটা।তাই শুধু শুভেন্দু গুপ্ত খুঁজে সে তার শুভদাকে পায়নি। হঠাৎ একটা ফেসবুক রিকোয়েস্টে তার চোখ আটকে যায়। অ্যাকসেপ্ট করেই ফোন করে ইনবক্সে। না,তার অনুমান ভুল নয়। এই শুভেন্দুই তার জীবন থেকে হারিয়ে যাওয়া শুভদা।

  যে কথা কেউ কোনদিন বয়স থাকতে বলতে পারেনি ফোনের দুই প্রান্তে দুটি শেষ বয়সের মানুষ সেই কথাগুলোই অকপটে স্বীকার করে, ফেলে আসা অতীত, ফেলে আসা কৈশোরকে যেন ছুঁতে চায় বারবার। শুভেন্দু এখন লন্ডনবাসী। সুখী দাম্পত্য জীবনে এক ছেলে আর এক মেয়ে। নিজ জীবনে আজ সে সুপ্রতিষ্ঠিত।
     অল্প বয়সে স্বামীহারা দু'সন্তানের জননী ছন্দার জীবন গতানুগতিক জীবনের বাইরে কোনদিনও পা ফেলতে পারেনি। বেঁচে আছে সে। অভাব,কষ্ট,দুঃখ সবকিছু নিয়েই। কিন্তু সত্যিই কী একে বাঁচা বলে? কিসের অভাব ছিল তার জীবনে? দেখতে মন্দ নয়, অবস্থাপন্ন ঘরের মেয়ে, পড়াশুনাতেও মন্দ ছিলো না। তবে বিধাতা কেন তার ভাগ্যটাকে নিয়ে এভাবে ছিনিমিনি খেললেন? জবাব নেই! কারণ ভাগ্যের উপর কারও হাত নেই। 

      জীবনের হিসাবের খাতা সব শূন্যই পড়ে রইলো ছন্দার জীবনে। আসলে মানুষ যা চায় তা পায় না। আর যা পায় তা কোনদিন স্বপ্নেও সে ভাবে না। এই চাওয়া পাওয়ার যাঁতাকলে জীবনে এমন একটা সময় আসে তখন আর নিজের জন্য মানুষ বাঁচে না, নিজের জন্য কিছু চায় না - সব চাওয়া সব ইচ্ছা হয়ে পড়ে তার সন্তানের জন্য। ছন্দার মত অভাগী মানুষগুলির শেষ বয়সে এসে হয়ত ঈশ্বরের কাছ এর থেকে আর কিছুই চাওয়ার থাকে না। 
         তবে ছন্দার জীবনে আর একটি চরম পাওয়া পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়ার আগে তার জীবনের প্রথম পুরুষটিকে দেরিতে হলেও সত্যিটা জানাতে পেরেছে। বিশ্বাস অবিশ্বাস বিচারের ভার অপরপ্রান্তের মানুষটির উপর। অবিশ্বাস করলেও যেমন কিছু যায় আসে না ,বিশ্বাস করলেও নয়। কারণ জীবন থেকে নতুন করে আর কিছুই চাওয়া বা পাওয়ার নেই।

  সব ভালোবাসা জীবনে পূর্ণতা পায় না। যে ভালোবাসা ছাদনাতলা় অবধি পৌঁছায় না সেখানে শুধু দূর থেকে ভালোবেসে প্রিয় মানুষটিকে খুশি থাকতে দেখেই খুশি থাকা যায়। তাই হয়ত কবিগুরু বলেছেন,
               "দূরত্ব যদি সত্যি সত্যিই 
               ভালোবাসার গভীরতা বাড়িয়ে দেয়,
                 তবে আমি দূরেই থাকতে চাই।"

 শেষ

Wednesday, October 4, 2023

ভালোবাসি বলেছি অনেকবার ( ৩য় পর্ব)


  দেবেশ গিয়ে মায়ের ঘরে ঢোকে। কিন্তু মাকে দেখাশুনা করার মেয়েটিকে সে দেখতে পায় না তখন। ওয়াশরুম থেকে জল পড়ার শব্দে বুঝতে পারে সে তখন ওয়াশরুমেই আছে। মায়ের কাছে এগিয়ে গিয়ে খাটের উপর মায়ের পাশে বসে। মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখে কপালে আগের সেই চাঁদের মত টিপ জ্বল জ্বল করছে। চুলগুলোও খুব সুন্দর করে আঁচড়ানো।
-- মা আজ তো তোমায় খুব ফ্রেস লাগছে। মেয়েটিকে পছন্দ হল?
 দেবেশের মা ছেলের কথা শুনে মুখে সামান্য হাসি এনে ছেলের একটি হাত নিজের দু'হাতের মধ্যে নিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন,
-- মেয়েটার মুখের মধ্যে কিছু একটা আছে জানিস? দেখলেই মনেহয় খুব কাছের কেউ। খুব আস্তে আস্তে কথা বলে। 
 -- তারমানে বলো মেয়েটিকে তোমার পছন্দ হয়েছে।তাহলে তো এবার বাইরে ট্রিটমেন্ট করতে যাওয়ার কোন অসুবিধা নেই। এতদিন তো কলকাতা ছেড়ে যেতে চাওনি বাইরে গেলে কে তোমার দেখাশুনা করবে? কারণ বাবা তার হাসপাতাল ছেড়ে বেশিদিন বাইরে গিয়ে থাকতে পারবেন না আর কোন আয়া কিংবা আমার প্রতি তোমার কোন ভরসা নেই। তাহলে বাবার সাথে কথা বলে বাইরে যাওয়ার দিনক্ষণ ঠিক করে ফেলি?
-- আরে দাঁড়া দুটো দিন যেতে দে। মেয়েটা কেমন একটু বুঝে নিতে দে।
--- আচ্ছা মা, আমায় একটা কথা বলো তো তুমি তোমার জন্য আয়া চাইছো নাকি ছেলের বিয়ের মেয়ে চাইছো?
 বিদিশা হেসে পড়ে ছেলের মাথার চুলগুলো নাড়িয়ে দিয়ে বলেন
-- সত্যি কেন রে তুই বিয়ে করতে চাস না। এই তো শরীরের হাল আমার। চলে যাওয়ার আগে একমাত্র ছেলের বউ দেখে যাবো না?
-- ছেলের বউ দেখে যেতে হলে সুস্থ হতে হবে। আমাদের কথা শুনে চিকিৎসা করাতে বাইরে যেতে হবে। তারজন্য মনের মত আয়ার দরকার হবে কেন?
-- আমি কী তাই বলেছি কখনো? আসলে বাইরে গেলে তোকে কিংবা তোর বাবাকে যে কাউকে আমাকে নিয়ে যেতে হবে। বাকি যে জন বাড়িতে থাকবে তার তো দেখভালেরও একজন চাই।
-- মা,তোমার এসব কথা শুনলে খুব হাসি পায়। বাড়িতে বিলাসী পিসি রয়েছে। বাবার কাছে শুনেছি দাদু,ঠাকুমা মারা যাওয়ার পর বিলাসী পিসিই বাবার সব কাজ করে দিতেন। বাবা তখন ডাক্তারী পড়ছেন। কয়েকমাসের ব্যবধানে বাবা,মাকে হারিয়ে বাবা খুবই ভেঙ্গে পড়েছিলেন। সেই সময় এই পিসিই তো বাবাকে সামলেছেন।
 বিদিশার কোন কিছুই অজানা নয়। তবুও তিনি চুপচাপ ছেলের কথা শুনে চলেছেন। ছেলে কথা বলে চলেছে অনর্গল তিনি ফিরে গেলেন স্বামীর কাছে গল্প শোনা অতীতে -
 স্কুল শিক্ষক বাবার একমাত্র ছেলে স্বরূপ। মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিকে ভীষণ ভালো রেজাল্ট করার পর বাবা,মায়ের ইচ্ছাতে জয়েন্টে বসা। ফলস্বরূপ পয়ষট্টি রাঙ্ক। সরকারিভাবে সুযোগ পেলেও এরপর কলকাতা থেকে পড়াশুনার বাকি খরচ চালানোর মত সামর্থ্য তাদের ছিল না। বিশাল একান্নবর্তী পরিবারের প্রায় পুরোচাই বহন করতেন শ্বশুরমশাই। ছেলে নিজেও আপত্তি জানিয়েছিল যে সে অন্য কোনভাবে পড়াশুনা শেষ করে ঠিক একটা চাকরি খুঁজে নেবে। কিন্তু তার বাবা, মা তা চাননি। স্বরূপের বাবা তাকে বলেছিলেন,
-- এসব নিয়ে তোমায় কিছু ভাবতে হবে না। তুমি ডাক্তারি পড়বে। কিভাবে পড়াবো সে ভাবনা আমার।
 শান্ত স্বভাবের স্বরূপ বাবার মুখের উপর কোনদিন কোন কথা বলেনি কিন্তু সে ভালোভাবেই জানতো কলকাতা হোস্টেলে থেকে পড়ানো তার বাবার পক্ষে কতটা কষ্টকর। কিন্তু কিসের উপর নির্ভর করে তার মা এবং বাবা তাকে কলকাতা পাঠাতে চাইছেন সেটাও সে ভালোভাবেই জানতো। মায়ের বিয়ের সময় মামাবাড়ি থেকে অনেক গয়না দাদু মাকে দিয়েছিলেন একমাত্র ধনীর ঘরের দুলালীর বিয়েতে। 
  দেবেশ কথা বলতে বলতে মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখে মা একটু অন্যমনস্ক। মায়ের হাতটা তার হাতের মধ্যেই ছিলো। হাতে মৃদু চাপ দিয়ে সে বলে,
-- মা তুমি কী ভাবছো বলো তো?
-- কই কিছু নাতো। তোর কথা শুনছি তো
 দেবেশ হেসে পড়ে বলে
-- মা, তোমার দেবু এখন অনেক বড় হয়ে গেছে। এখন আমি তোমার প্রত্যেকটা মুভমেন্ট কী বলতে চাইছে বলে দিতে পারি ঠিক তুমি যেমন করে আমার কথা বলে দাও।
 বিদিশা হো হো করে হাসতে থাকেন। অনেকদিন পরে মায়ের এই প্রাণখোলা হাসি দেখে মাকে জড়িয়ে ধরে আদর করতে থাকে। 
  বাথরুম থেকে বেরিয়ে জামাকাপড় নিয়ে সুবর্ণা ছাদে চলে যায়। সেখানে গিয়ে কমকরে পাঁচশ টবে ফুটে থাকা নানান ফুলগাছে এবং তাতে ফুল ফুটে থাকায় সে এতটাই মোহিত হয়ে যায় বিদিশার কাপড়চোপড় মেলে আসতে তার অনেকটাই দেরি হয়ে যায়। ছাদের কাজ সেরে সে নিচে নেমে এসে বিদিশার ঘরে ঢুকতে গিয়ে পরিচিত একটা গলার আওয়াজ পেয়ে দরজার বাইরেই দাঁড়িয়ে পড়ে। পর্দার ফাঁক দিয়ে উকি দিয়ে দেখেই নিজের বুকটা নিজেই চেপে ধরে। নিজের অজান্তেই নিশ্বাস প্রশ্বাস ঘন হয়। পা দুটো আস্তে আস্তে অসার হতে থাকে। সুবর্ণা দরজার বাইরেই দাঁড়িয়ে থাকে।
   স্বরূপ কলকাতা চলে এলো ডাক্তারি পড়তে। প্রথম প্রথম হোস্টেলের খাওয়াদাওয়া, নিয়মকানুনের সাথে খাপ খাওয়াতে স্বরূপকে অনেক বেগ পেতে হয়েছে। গ্রামের খোলামেলা পরিবেশে বড় হওয়া স্বরূপ হোস্টেলের এই বদ্ধ পরিবেশে মানিয়ে নিতে খুব কষ্ট করতে হয়েছে। কিন্তু আস্তে আস্তে সব কিছুর সাথেই মানিয়ে নিতে সে সক্ষম হয়েছে। আর না হয়েই বা উপায় কী? মেডিকেল পড়ার যে বিশাল চাপ তার থেকে এক মুহূর্তও সময় বের করা সম্ভব হয়ে ওঠে না।
   একান্নবর্তী পরিবারের সন্তান স্বরূপ ভালোভাবেই জানতো বাবার টাকাতেই সংসারের সিংহভাগটা চলে। জমিজমা আজও দাদুর নামে। বাবা,কাকারা আজও ওই জমির ব্যাপারে কেউ কোনদিনও মাথা ঘামাননি। যেমন ছিল তেমনই আছে। স্বরূপের বুঝতে একটুও বাকি রইলো না প্রতিবার যখন টাকা আসে মায়ের এক একটা করে গয়না কমতে থাকে। কিন্তু বাবার কথানুযায়ী কোনদিকে না তাকিয়ে ভালোভাবে ডাক্তারি পাশ করতে হবে। এইভাবেই দিন গড়িয়ে মাস, মাস গড়িয়ে বছর চলে যেতে থাকে। তখন স্বরূপের ডাক্তারির ফাইনাল ইয়ার। সেদিন প্রচণ্ড গরম পড়েছিল। তারউপর লোডশেডিং। হোস্টেলের ছোট রুম ছেড়ে তখন সকলেই বাইরে। 
 অন্ধকার আর গরমের মধ্যেও সকলে হৈ হট্টগোলে মেতে উঠেছে। হঠাৎ একটি নারী কন্ঠের আর্তচিৎকারে কিছুক্ষনের জন্য সবাই হকচকিয়ে যায়। কোথা থেকে আওয়াজটা আসছে সেটা বুঝতেই বেশ কয়েক সেকেন্ড চলে যায়। ডাক্তারি পাঠরত ছেলেগুলো তখন গেট খুলে এদিকে ওদিকে তাকিয়ে দেখছে। অসুস্থ অবস্থায় একজন তরুণী পেটের যন্ত্রণায় ছটফট করছেন। ছেলেগুলো তাকে পাঁজাকোলা করে নিয়ে এসে হাসপাতালে ভর্তি করে।
 ওই তরুণীর কাছ থেকে জানা যায় তার নিজের কেউ নেই। এক বাড়িতে খাওয়াপরায় সে থাকতো ছোট থেকেই। কিন্তু ওই বাড়ির গিন্নি বাড়িতে না থাকায় গৃহকর্তা রাতে তার ঘরে আসে। আগে কোনদিনও এরূপ তিনি করেননি। তাই প্রথম অবস্থায় সে কিংকর্ত্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে। গৃহকর্তার সাথে ধস্তাধস্তি করে পালাতে গিয়ে টেবিলের কোণে পেটে প্রচণ্ড ধাক্কা খায়। ওই ব্যথা নিয়েই সে দৌড়াতে থাকে। শেষ পর্যন্ত এইখানে এসে সে আর পারে না। যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যায়। 
 তার কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। এখন ভিক্ষে করে পথেঘাটে পড়ে থাকা ছাড়া তার আর কোন উপায় নেই। মেডিকেল পাঠরত ছেলেগুলো তখন বড়ই বিপদে পড়ে। কিন্তু কারোরই সাহস হয় না এই বয়সের একটি মেয়েকে তাদের বাবা,মাকে বলে নিজেদের বাড়িতে আশ্রয় দেওয়ার। 
 স্বরূপ প্রফেসরদের সাথে কথা বলে কয়েকটা দিন মেয়েটিকে হাসপাতালেই রাখার ব্যবস্থা করে। মেয়েটিকে জানায় কয়েকদিনের মধ্যে বাড়ি যাবে সে। বাড়ি যাওয়ার সময় তাকে সঙ্গে করে নিয়ে যাবে। মেয়েটিরও আর কোন উপায় ছিল না স্বরূপকে এই মুহূর্তে বিশ্বাস করা ছাড়া। তাই সে উপকারীর উপকার স্বীকার স্বরূপ প্রথম দিন থেকেই স্বরূপকে দাদা বলে ডাকতে থাকে। স্বরূপ যতই তাকে আশ্বাস দিক না কেন তার মনে একটা আশঙ্কা থেকেই যায়। প্রায় সমবয়সী কিংবা বয়সে একটু ছোট এই মেয়েটিকে বাড়িতে নিয়ে গেলে এত বড় পরিবারের সদস্যরা ঠিক কিভাবে নেবেন। বাবা,মায়ের কথা বাদ দিলেও বাদবাকীরা কিছুতেই এটা ভালো চোখে দেখবেন না। কিন্তু তবুও মনে একটা আশা ছিলো যেহেতু তার বাবার উপর অনেকটাই সকলে নির্ভরশীল তাই বাবা মেনে নিলে অন্যদের মনে নানান অভিযোগ থাকলেও কেউ বাবার মুখের উপর কিছু বলতে পারবে না।   
 স্বরূপের এই এক মস্ত দোষ ছেলেবেলা থেকেই। কেউ বিপদে পড়লেই কোনকিছু না ভেবেই তার পাশে দাঁড়িয়ে পড়ে। এক্ষেত্রেও ঠিক তাইই হল। মেয়েটিকে আশ্রয় দিতে যখন অন্যান্য ক্লাসমেটরা রাজি হল না তখন সেই মেয়েটিকে তার সাথে বাড়িতে নিয়ে যাওয়ায় ঠিক করলো।

ক্রমশ