দুই বিনুনী ঝুলিয়ে স্কুলে যাওয়ার পথে রেখা রোজ ছন্দাদের বাড়ি আসে। দু'জনে একসাথে বাকি পথটা হেঁটে স্কুলে পৌঁছায়। রেখাদের বাড়ি গ্রামে হলেও ভাইবোনেরা সব মফস্বল শহরে ঘরভাড়া নিয়ে থাকে লেখাপড়ার সুবিধার্থে। আর ছন্দার বাবা শহরে একজন নামজাদা উকিল। ছন্দার বাবা সমরেশ চৌধুরী তার ছেলেমেয়ে নিয়ে নিজের বাড়িতেই থাকেন।
জমিদার বাড়ির সন্তান হওয়ার সুবাদে গ্রামে প্রচুর জমিজমা, পুকুর, বাগান ইত্যাদি থাকার ফলে সমরেশ বাবুকে প্রতি শনিবার করেই গ্রামে যেতে হয়। সেখানে তাঁর স্ত্রী,মা ও এক মাত্র ছেলে থাকে। সমরেশ বাবুর পরপর বেশ কয়েকটি মেয়ে হওয়ার পর প্রায় মধ্য বয়সে এসে এই পুত্র সন্তানের জন্ম। স্বাভাবিকভাবেই সে সকলের খুব আদরের। আর বয়স যেহেতু এখন তার খুবই কম সে তার মায়ের সাথে গ্রামের বাড়িতেই থাকে।
রেখার বাবা স্কুল শিক্ষক।তিনি ও তার স্ত্রী গ্রামেই থাকেন। কিন্তু পড়াশুনার সুবিধার্থে তার ছেলেমেয়ে শহরে ঘরভাড়া করে থাকে। রেখা ও ছন্দাদের বাড়ি একই পাড়ার কয়েকটা বাড়ির পর। পড়েও তারা একই ক্লাসে। রেখার দাদার তখন কলেজে প্রথম বর্ষ। দাদা শুভেদু পড়াশুনায় তুখোড়। এক মাথা ঝাঁকড়া চুল, বুদ্ধিদীপ্ত দু'টি চোখ, টানা ভ্রু। গায়ের রং বেশ চাপা।সুদর্শন বলতে যা বোঝায় শুভেন্দু তা কোনদিনও ছিলো না। ছিল তার একটা আলগা চেহারা। কোন মেয়ে প্রথম দর্শনেই তার প্রেমে পড়বে না একথা ঠিক কিন্তু তার মায়াভরা মুখটার মধ্যে এমন কিছু ছিলো, তার সাথে মিশলে কথা বললে তার সরলতা আর ওই মায়াভরা মুখটা মিলে একটা ভালোলাগা কাজ করতো।
ছন্দা তাকে যে খুব একটা পছন্দ করতো তা নয়। আবার খুব যে একটা অপছন্দ করতো তাও নয়। কিন্তু বিকেল হলেই কী এক অমোঘ টানে ছন্দা ছুটে যেত রেখাদের বাড়িতে। ছন্দা যখনই তাদের বাড়িতে গেছে সে লক্ষ্য করেছে রেখার দাদা শুভেন্দু মাথা গুঁজে বইয়ের টেবিলে বসা। কলেজ থেকে ফিরে এসে শুভেন্দু কিন্তু ওই সময়টা বাড়িতে তার পড়ার টেবিলেই বসে পড়তো কিংবা বলা ভালো পড়ার ভান করে ছন্দাকে লক্ষ্য করতো। বেশ কয়েকবার প্রতিদিনই দু'জনে চোখাচোখি হয়েছে। কিন্তু দু'প্রান্তের দু'জনেই ভালোলাগা কিংবা ভালোবাসার কথা কেউ কাউকেই বলতে পারেনি। হয়ত বলা ভালো ওই বয়সে ওই সময়ে ভালোবাসাটা তারা নিজেরাও বুঝতে পারেনি। কিন্তু বিকেল হলেই শুভেন্দুকে একটিবার চোখের দেখার অদম্য এক শক্তি ছন্দাকে তার বাড়ির দিকে টেনে নিয়ে যেত। আর অদ্ভুতভাবে শুভেন্দুও বিকেলের ওই সময়টুকু কোনদিনও বাড়ির বাইরে পা রাখেনি।
এমনই একদিন ছন্দা যখন রেখাদের বাড়ি যায় সেই মুহূর্তে রেখা ঘরে না থাকায় ওর দাদার পড়ার টেবিলের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে দেখে শুভেন্দু একমনে একটা ছবি আঁকছে। ছন্দা তার কিছুটা কাছে এগিয়ে গিয়ে বলে,
--- তুমি কী সুন্দর ছবি আঁকো দাদা। আমার একটা ছবি এঁকে দেবে?
শুভেন্দু চোখ তুলে ছন্দার মুখের দিকে তাকায়। ওই চোখের দিকে তাকিয়ে মুহূর্তে ছন্দার বুকের ভিতর বিদ্যুৎ খেলে যায়। সে চোখ নামিয়ে নেয়। শুভেন্দু সে কথার উত্তর না দিয়ে যে ছবিটা দেখে সে তার খাতার পাতায় ছবি আঁকছিল সেটা ছন্দার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,
-- এই ছবিটা তুমি রাখো। তোমাকে কিন্তু ববিতার মতোই দেখতে।তাই আলাদা করে ছবি আর আঁকতে হবে না।
ছবিটা ছিলো বাংলাদেশের সিনেমার নায়িকা ববিতার। শুভেন্দু একবার ছবিটার দিকে আর একবার ছন্দার দিকে তাকিয়ে ছন্দার হাতে ছবিটা দিতে দিতে বলে,
-- আসলে তোমার চেহারাটা আর ববিতার চেহারার কোথায় যেন একটা মিল আছে। তাই ববিতাকে সামনে রেখে ছন্দাকে আঁকার চেষ্টা করছিলাম।
ছবিটা ছন্দার হাতে দেওয়ার সময় শুভেন্দুর হাতের স্পর্শে ছন্দার বুকের ভিতর আর একবার কেঁপে ওঠে। কিন্তু কিশোরী ছন্দার এ কেঁপে ওঠার মানে বোঝার মত বুদ্ধি তখনো তার হয়নি। এরফলে তার মনের ভিতরে একটা ভয়ের বাতাবরণ তৈরি হয়। সে ওই বাড়িতে যাওয়া বন্ধ করে দেয়। শুভেন্দুকে রোজ একটিবার চোখের দেখার ইচ্ছাকে নিজের মনের বিরুদ্ধে গিয়ে চাপা দিয়ে রাখে।
এর বেশ কয়েকদিন পরে একদিন স্কুলে রেখা ছন্দাকে বলে,
-- তুই আজ কয়েকদিন আমাদের বাড়িতে যাস না কেন?
ছন্দা কিছুটা সময় চুপ করে থেকে বলে,
--- যাবো আজ
-- তোর সাথে আমার একটা কথা আছে। কথাটা তোকে আমি বলছি ঠিকই কিন্তু কথাটা আমার নয়। একজনের কথা সে তোকে বলতে লজ্জা পাচ্ছে তাই আমি বলে দিচ্ছি।
রেখার এই হেয়ালিপূর্ণ কথা ছন্দা কিছুই বুঝতে পারে না। সে রেখার দিকে তাকিয়ে থাকে। রেখা আর কোন ভনিতা না করে সরাসরি বলে,
--- আমার দাদা তোকে ভালোবাসে রে -
পড়াশুনায় চিরমেধাবী ছন্দা ভবিষ্যতে ডাক্তার হওয়ার ইচ্ছায় পড়াশুনাটাকেই জীবনে প্রাধান্য দিয়ে এসেছে। হঠাৎ করে রেখার মুখে এই কথা শুনে ছন্দা অবাক হয়ে রেখার মুখের দিকে তাকায়। ছন্দার এই তাকানো দেখে রেখা কিছুটা ঘাবড়ে গিয়ে বলে,
-- আমার দাদা কিন্তু ভবিষ্যতে ডাক্তারী কিংবা ইঞ্জিনিয়ারিং লাইনে যাবে।
শুভেন্দুর স্পর্শে এই যে বুকের ভিতর কেঁপে ওঠা এই যে বিকেল হলেই তাকে দেখার এক অদম্য ইচ্ছা কিশোরী ছন্দা তখনও বুঝে উঠতে পারেনি এটাই ভালোবাসা। বাবার আত্মসম্মান আর নিজের জীবনের স্বপ্ন এই দুইয়ের কারণেই হয়ত সে এ'দিকটা সারা জীবনের মত ঘুম পারিয়ে রাখতে চেয়েছিল। রেখার কথা শুনে তার মুখের দিকে তাকিয়ে শুধু একটা কথাই সে বলেছিলো,
-- ভবিষ্যতে কে কোন লাইনে যাবে তা কি এখনই বলা যায়?
রেখা শুধু বিষণ্ণ মনে ছন্দার দিকে তাকিয়ে ছিল। রেখা তার দাদাকে কী বলেছিলো ছন্দা তা কোনদিনও জানতে চায়নি কিন্তু সেদিন রাতেই শুধু নয় ওই ছবিটা যখনই ছন্দা হাতে নেয় আজও সে সেই মানুষটার ছোঁয়া অনুভব করে।
এই ঘটনার কিছুদিনের মধ্যেই রেখার এক মারত্মক অসুখ হওয়াতে সে গ্রামের বাড়ি মা,বাবার কাছে চলে যায়। স্কুল আসা বন্ধ হয়। অন্য ভাইবোনদেরও পড়াশুনা শেষ হওয়ায় যে যার জায়গায় প্রতিষ্ঠিত হয়ে যে যার মত জীবন কাটাতে থাকে। শহরে শুধু থেকে যায় শুভেন্দু। কিন্তু ওই বাড়িতে নয় অন্য কোথাও।
স্মৃতির পাতা ঝাপসা হলেও ববিতার ছবিটা ছন্দার জীবনে প্রথম ভালোলাগা,ভালোবাসার স্পর্শ হিসাবে সে অতি যত্ন করে নিজের কাছেই রেখে দেয়। কিন্তু ছন্দা যখন বুঝতে পারে শুভেন্দুকে সে ভালোবেসে ফেলেছিল তখন সে অনেক দেরি করে ফেলেছিল। সেই সময় যখনই সে রাস্তায় বেরোত তার চোখদু'টি ওই মানুষটাকেই খুঁজতো। কিন্তু কোথায় সে? ছন্দার সামনে দাঁড়িয়ে তার মনের খবর না জেনে চিরদিনের মত ছন্দাকে ভুল বুঝে সে যেন ছোট্ট শহরটা থেকেই হারিয়ে গেলো।
এরপর কেটে গেছে যুগের পর যুগ। হিন্দুদের প্রতি চরম অত্যাচারের বিপর্যয় ভোগান্তি সমরেশ চৌধুরীর পরিবারের উপর মারত্মক আঘাত হানে। চলে আসে ছন্দারা ভারতের মাটিতে। কিশোরী ছন্দা তখন যৌবনে পৌঁছেছে। এই বিপর্যয়ের ভিতরে জন্মভিটে, লাতিত শৈশব, কৈশর সবকিছু ফেলে আসলেও ফেলে আসতে পারেনি ববিতার ছবিটি। প্রথম ভালোলাগার প্রথম ছোঁয়া হিসাবে অতি সযত্নে সে ছবিটি তার সাথে করেই নিয়ে আসে।
তারপরেও কেটে গেছে বহুযুগ। বিয়ের পরও পুরনো সেই ছবি ছন্দার নতুন অ্যালবামে ঠাঁই পেয়েছে। কিছুতেই সে যুগ যুগ পড়েও শুভেন্দুকে ভুলতে পারেনি।
জীবনে ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন কবে কোথায় যে কিভাবে হারিয়ে গেলো তা ছন্দারও জানা নেই। গতানুগতিকভাবে সংসার জীবনে পাওয়া না পাওয়ার হিসাব করতে করতেই জীবন থেকে ছাপ্পান্নটা বছর পার হয়ে গেছে। কিন্তু আজও মনের কোথাও না কোথাও প্রথম ভালোলাগার মানুষটা সেই আগের মতই রয়ে গেছে। কোথাও যেন একটা অপেক্ষা ছন্দার জীবনে এই বয়সেও কাজ করে।
এখন এন্ড্রোয়েড ফোনের দৌলতে পৃথিবী আজ হাতের মুঠোই। কিন্তু শুভেন্দু গুপ্তের কোন খোঁজ সে ফেসবুকের কোথাও পায়নি। তার জীবনের না বলা কথাটা বলার জন্য ছন্দা যেন ধনুকভাঙা পণ করে শুভেন্দুর অপেক্ষায় বসেই আছে। খুঁজে চলেছে ফেসবুকও।
কী করেই বা সে শুভেন্দু গুপ্তকে পাবে? শুভেন্দু আজ নামকরা একজন ডাক্তার। তার নামের আগে জ্বলজ্বল করে ডাক্তার শব্দটা।তাই শুধু শুভেন্দু গুপ্ত খুঁজে সে তার শুভদাকে পায়নি। হঠাৎ একটা ফেসবুক রিকোয়েস্টে তার চোখ আটকে যায়। অ্যাকসেপ্ট করেই ফোন করে ইনবক্সে। না,তার অনুমান ভুল নয়। এই শুভেন্দুই তার জীবন থেকে হারিয়ে যাওয়া শুভদা।
যে কথা কেউ কোনদিন বয়স থাকতে বলতে পারেনি ফোনের দুই প্রান্তে দুটি শেষ বয়সের মানুষ সেই কথাগুলোই অকপটে স্বীকার করে, ফেলে আসা অতীত, ফেলে আসা কৈশোরকে যেন ছুঁতে চায় বারবার। শুভেন্দু এখন লন্ডনবাসী। সুখী দাম্পত্য জীবনে এক ছেলে আর এক মেয়ে। নিজ জীবনে আজ সে সুপ্রতিষ্ঠিত।
অল্প বয়সে স্বামীহারা দু'সন্তানের জননী ছন্দার জীবন গতানুগতিক জীবনের বাইরে কোনদিনও পা ফেলতে পারেনি। বেঁচে আছে সে। অভাব,কষ্ট,দুঃখ সবকিছু নিয়েই। কিন্তু সত্যিই কী একে বাঁচা বলে? কিসের অভাব ছিল তার জীবনে? দেখতে মন্দ নয়, অবস্থাপন্ন ঘরের মেয়ে, পড়াশুনাতেও মন্দ ছিলো না। তবে বিধাতা কেন তার ভাগ্যটাকে নিয়ে এভাবে ছিনিমিনি খেললেন? জবাব নেই! কারণ ভাগ্যের উপর কারও হাত নেই।
জীবনের হিসাবের খাতা সব শূন্যই পড়ে রইলো ছন্দার জীবনে। আসলে মানুষ যা চায় তা পায় না। আর যা পায় তা কোনদিন স্বপ্নেও সে ভাবে না। এই চাওয়া পাওয়ার যাঁতাকলে জীবনে এমন একটা সময় আসে তখন আর নিজের জন্য মানুষ বাঁচে না, নিজের জন্য কিছু চায় না - সব চাওয়া সব ইচ্ছা হয়ে পড়ে তার সন্তানের জন্য। ছন্দার মত অভাগী মানুষগুলির শেষ বয়সে এসে হয়ত ঈশ্বরের কাছ এর থেকে আর কিছুই চাওয়ার থাকে না।
তবে ছন্দার জীবনে আর একটি চরম পাওয়া পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়ার আগে তার জীবনের প্রথম পুরুষটিকে দেরিতে হলেও সত্যিটা জানাতে পেরেছে। বিশ্বাস অবিশ্বাস বিচারের ভার অপরপ্রান্তের মানুষটির উপর। অবিশ্বাস করলেও যেমন কিছু যায় আসে না ,বিশ্বাস করলেও নয়। কারণ জীবন থেকে নতুন করে আর কিছুই চাওয়া বা পাওয়ার নেই।
সব ভালোবাসা জীবনে পূর্ণতা পায় না। যে ভালোবাসা ছাদনাতলা় অবধি পৌঁছায় না সেখানে শুধু দূর থেকে ভালোবেসে প্রিয় মানুষটিকে খুশি থাকতে দেখেই খুশি থাকা যায়। তাই হয়ত কবিগুরু বলেছেন,
"দূরত্ব যদি সত্যি সত্যিই
ভালোবাসার গভীরতা বাড়িয়ে দেয়,
তবে আমি দূরেই থাকতে চাই।"
শেষ