Tuesday, May 23, 2023

একদিন ভালোবাসবে (৬৫ পর্ব)

একদিন ভালোবাসবে (৬৫ পর্ব)

  দীপিকা কলকাতা আসছে শুনে সৌম্য অবাক হয়ে যায়। সে জানতে চায় 
-- কলকাতা আসছো? কিন্তু তুমি তো বলেছিলে তোমার কেউ নেই 
 দীপিকা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে, 
-- নিরুপায় হয়ে মিথ্যে বলতে হয়েছিলো। কিন্তু মা অর্থাৎ তোমার মা সব জানতেন। তাকে আমি একটি কথাও মিথ্যে বলিনি। তিনিই আমায় বারন করেছিলেন প্রকৃত সত্যতা কাউকে না জানাতে।
-- তাহলে তো আমার কিছু বলার নেই। কে কে আছেন তোমার পরিবারে সেটা কি এখন বলা যাবে?
-- মা,বাবা দু'জনেই আছেন। 
-- বিশেষ কেউ?
 দীপিকা চুপ করে আছে দেখে সৌম্য বললো,
-- আচ্ছা ঠিক আছে।বলতে হবে না। কলকাতা এসে ফোন করো দেখা করবো। ওখানে একা একা থাকার চেয়ে আমার মনেহয় কলকাতায় থাকা অনেক ভালো।
 ভেবে দেখো। মনে রাখবে যেখানেই থাকো না কেন সব সময় আমি সাথে আছি।

  খুবই কষ্ট করে সুজয় সেদিন টিকিট জোগাড় করে। রিজার্ভেশন কনফার্ম না হলেও তারা ট্রেনে চেপে বসে। অনেক কষ্টে তারা পরদিন কলকাতায় পৌঁছায়। বাড়িতে যখন তারা পৌঁছায় তখনও দীপিকার বাবার জ্ঞান আছে। সুজয় রাস্তা থেকেই নিজের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।।দীপিকা তার দিকে তাকিয়ে শুধু বলে, "থ্যাঙ্কস" । সুজয় তার মুখের দিকে তাকিয়ে পড়লে সে চোখ নামিয়ে মেয়ের হাত ধরে বাড়ির দিকে রওনা দেয়।
  বাড়িতে পৌঁছেই দৌড়ে বাবার ঘরে ঢুকে বাবার বুকের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। তার সে আকুল কান্না দেখে বাড়িতে উপস্থিত অন্য সকলের চোখেও জলের ধারা নামে। বাবার মুখের কাছে মুখটা নিয়ে বলে,
-- বাবা, আমি তোমার দীপু। আমায় চিনতে পারছো। আমায় ক্ষমা করে দাও বাবা। আমি স্বার্থপরের মত নিজের কথাই ভেবেছি শুধু। তোমাদের আমি খুব কষ্ট দিয়েছি। আমি জানি এ অপরাধের কোন ক্ষমা হয় না। কিন্তু তোমরা আমায় ক্ষমা না করলে স্বয়ং ঈশ্বর আমার অপরাধের ক্ষমা করবেন না। 
 দীপিকার বাবার ঠোঁট দুটো কেঁপে উঠলো। চোখের কোল বেয়ে দুফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো। মুখের কোণে মৃদু হাসি নিয়ে মুখটা হা করলেন। পিসিমা এগিয়ে এসে একটা চামচে জল নিয়ে দীপিকার হাতে দিয়ে বললেন,
-- একটু একটু করে দাদার মুখে এই জলটা দে।
 দীপিকা কাঁদতে কাঁদতেই বাবার মুখে একটু একটু করে পুরো জলটা দিলো তিনি ঢোক গিলে তার একমাত্র আদরের সন্তান দীপুর হাত থেকে পৃথিবী ছাড়ার আগে জল খেলেন। চোখটা আধো খুলে মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। সেই চোখ পরে তার আদরের সন্তান কখনো দীপা আবার কখনো বা দীপু বলে ডাকা মেয়েটি কাঁদতে কাঁদতেই হাত দিয়ে বন্ধ করে দিলো।
   বাড়ির সামনে লোকজন ভর্তি। সকলের মাঝে দীপিকা সুজয়কেউ দেখতে পেলো। আসার পর থেকে কেঁদেই চলেছে। যখন সবাই বললো, "দীপা শ্মশানে যাবে মুখাগ্নি করতে -" প্রথমে দীপিকা আপত্তি জানালেও পরে মায়ের কথায় রাজি হয়। ঠিক এই মুহূর্ত থেকেই দীপিকার ভিতর অদ্ভুত এক শক্তি কাজ করতে থাকে। সে ভাবতে থাকে এতদিন সে যা অন্যায় করেছে তার বাবা,মায়ের প্রতি একটু একটু করে তার সব অন্যায়ের মাসুল তাকেই দিতে হবে। আজ বাবা নেই। মায়ের সব দায়িত্ব তাকেই নিতে হবে। মাকে আর সে কষ্ট পেতে দেবে না। একমাত্র সন্তান হয়েও সে এতদিন তাদের যে কষ্ট দিয়েছে তার কোনই অধিকার ছিল না তাদের এই কষ্ট দেওয়া। দীপিকার এখন মনে হচ্ছে এতগুলো বছর সে যেন একটা ঘোরের ভিতর ছিলো। 
  শ্মশানের যাবতীয় কাজ সে নিষ্ঠার সাথে পালন করে গঙ্গায় স্নান সেরে নতুন বস্ত্র পরে বাড়ি আসে। বাড়িতে ফেরার পর এই প্রথম সে মায়ের বুকের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে কাঁদতে কাঁদতে বলে,
-- আমায় ক্ষমা করে দাও মা। আজ আমি মা হয়ে বুঝতে পেরেছি তোমার আর বাবার প্রতি আমি কী অন্যায় করেছি। তখন শুধুই নিজের কথাই ভেবেছি। তোমাদের কষ্ট,তোমাদের দুঃখ এসব মাথায় ছিলো না। আমার জন্যই বাবা এত তাড়াতাড়ি আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। এ কষ্ট আমি কোনদিন ভুলতে পারবো না।
  দীপিকার মা মেয়ের এ আকুল কান্নার মাঝেও নিজেকে সংযত রেখে মেয়ের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলেন,
--- যা হয়ে গেছে তা নিয়ে ভেবে লাভ নেই। তোর বাবার এ টুকুই আয়ু ছিলো। শান্তনা একটাই তিনি চলে যাওয়ার আগে তোকে দেখে গেছেন। কিন্তু তোর কাছে আমার অনেক কিছু জানার আছে। 
-- বলবো মা তোমাকে সব বলবো। তোমাকে একা রেখে আর আমি যাবো না। আমার ভুলের মাসুল সারাজীবন ধরে দেবো। কিন্তু তোমাকে আর আমি কষ্ট পেতে দেবো না। আমার জন্য এতগুলো বছর তুমি আর বাবা অনেক কষ্ট পেয়েছ।
-- ওসব কথা ছার কী ঘটেছিল কেন কাউকে কিছুই না বলে এভাবে পালিয়ে গেলি? আমরা তো তোর পছন্দ করা ছেলের সাথেই তোর বিয়ে ঠিক করেছিলাম। তারপর কাকে তুই বিয়ে করলি সব আমায় জানা। দিদিভাইয়ের বাবার নাম কী? সে কোথায়? তুই শাঁখা,সিঁদুর পরিস না কেন?
 মায়ের এতগুলো প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে চোখের জল মুছে দীপিকা মায়ের সামনে শক্ত হয়ে বসে।

ক্রমশ
  

Monday, May 15, 2023

একদিন ভালোবাসবে (৬৪ পর্ব)

একদিন ভালোবাসবে (৬৪ পর্ব)

  সুজয় মহিলার কাছে জানতে পারে দীপিকার বাবার শরীর খুব খারাপ। আর সেই জন্যই তিনি এখানে এসেছেন। সম্পর্কে তিনি দীপিকার পিসি হন। সুজয় এই মহিলাকে না চিনলেও মহিলা সুজয়কে চিনতেন। কারণ দীপিকার সাথে তার বিয়ে ঠিক হওয়ার পর তিনি যখন এই বাড়িতে এসেছিলেন তখন সুজয়কে তিনি দেখেছেন। তিনি সুজয়কে নিষেধ করেন সে যেন তার দাদার সামনে না যায়। সুজয় অনেক করে বুঝানোর চেষ্টা করে তাকে দেখা করতেই হবে। তাদের কথাবার্তার মাঝে দীপিকার মা এসে পড়েন।তিনি সুজয়কে দেখেই চিৎকার করে বলে ওঠেন,
-- তুমি কোন সাহসে এই বাড়িতে এসেছো? বেরিয়ে যাও এখান থেকে।
  সুজয় ধীর,শান্তভাবে বলে,
-- আমি দীপিকার খোঁজ পেয়েছি।
 সুজয়ের মুখ থেকে চিৎকারের মধ্যে এই কথাটা শুনে তিনি সুজয়কে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলেন,
-- কোথায়? কোথায় ?আমার দীপা? ওর বাবার এই শেষ সময়ে দীপাকে একবার ওর বাবার সামনে নিয়ে এসো। তানাহলে যে মানুষটা মরেও শান্তি পাবে না।
-- আমার সাথে সে আসবে না। আপনারা কেউ সঙ্গে গেলে আমি আপনাদের নিয়ে যেতে পারি।
-- কোথায় আছে সে এখন?
-- দার্জিলিং 
 পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ভদ্রমহিলার দিকে তাকিয়ে দীপার মা বললেন,
-- ও দিদি, আর একবার ছেলেটাকে বিশ্বাস করে ওর সাথে তুমি যাও - গিয়ে আমার মেয়েটাকে নিয়ে এসো।

   বহুদিন পর নিজের আত্মীয়কে সামনে দেখে দীপা কান্নায় ভেঙে পড়ে। শ্রেষ্ঠাকে দেখিয়ে বলে,
-- পিসি তোমাদের নাতনী 
-- জামাই কোথায়?
 দীপিকা চুপ করে থাকে। সুজয় ঘরে না ঢুকে বাইরেই দাঁড়িয়ে ছিলো। হঠাৎ পিসিকে দেখে সে এতটাই বিহ্বল হয়ে পড়েছিল কিভাবে খবর পেয়েছে, কার সাথে এসেছে এগুলো জানতে চাওয়ার কথা মনেই আসেনি। কিন্তু পিসির মুখে 'জামাই কোথায় ?' কথাটা শুনে দীপিকা যখন চুপ করে আছে সেটা লুকিয়ে দেখতে পেয়ে সুজয় ঘরে ঢুকে বলে,
-- আমি তোমাদের জামাই হতে পারিনি ঠিকই কিন্তু তোমাদের নাতনীর বাবা আমি।
  দীপিকা সুজয়ের দিকে তাকিয়ে পড়ে। সুজয় দাঁড়িয়ে আছে দেখতে পেয়ে একটা বেতের মোড়া নিয়ে এসে সুজয়ের সামনে রাখে। সুজয়কে দেখতে পেয়ে পিসিদিদার দু'হাতে জড়িয়ে রাখা কোলের ভিতর থেকে শ্রেষ্ঠা বেরিয়ে ঘরের ভিতরে যেতে উদ্যোগী হলে দীপিকা বলে,
-- মামনি তুমি আজ এখানেই থাকো। আর এদের প্রণাম করো। 
 শ্রেষ্ঠা দিদাকে প্রণাম করে সুজয়কে প্রণাম করতে গেলে সুজয় দু'হাতে তাকে বুকের সাথে চেপে ধরে। দীপিকার পিসি তখনও কিছুই বুঝে উঠতে পারছেন না। সন্তান সুজয়ের, সুজয় বিয়ে করেছে অন্যকে। সবকিছু তার গুলিয়ে যাচ্ছে তখন। এতক্ষণ তিনি তার আসার আসল কারণটাই জানাননি। এবার তিনি দীপাকে বললেন,
-- সবকিছু কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে আমার। তোর মুখ থেকে সবকিছুই জানবো। তার আগে যে জন্য এসেছি সেই কথাটা বলি দীপা। দাদার শরীর মোটেই ভালো না। শুনতে খারাপ লাগলেও এটাই সত্যি দাদা আর বাঁচবেন না। আরো কিছুদিন হয়ত বাঁচতেন কিন্তু তোর শোকে বেশ কয়েক বছর ধরেই তিনি শয্যাশায়ী। তোর মা আমায় পাঠিয়েছেন তোকে বাড়িতে নিয়ে যেতে। শেষ সময়ে যাতে একবার তোকে দেখে যেতে পারেন।
  পিসির কথা শুনে দীপিকার দু'চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়তে থাকে। পিসি আবার শুরু করেন,
-- হ্যাঁ কিছুটা হলেও তোর জীবনের কী ঘটেছিল আমি আন্দাজ করতে পারছি। তবুও বলবো সুজয় তোর খবরটা না দিলে আমরা জানতেও পারতাম না কোনদিন তুই বেঁচে আছিস। আমরা তো ধরেই নিয়েছিলাম -
 পিসি কথাটা আর শেষ করেন না। দীপিকা তখন বলে,
-- ন'বছর আগে আমার চারপাশটা যখন অন্ধকার হয়ে গেছিলো তখন একটা পরিবার আমার সমস্ত দায়িত্ব নিয়ে আজও আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। আমি এইখানে একটা স্কুলে ছোট ছোট বাচ্চাগুলোকে পড়াই। আমি অবশ্যই যাবো তোমার সাথে বাড়িতে।কিন্তু তার আগে আমাকে দু'জনের কাছ থেকে অনুমতি নিতে হবে। এক হচ্ছে সেই পরিবারের জীবিত একমাত্র সদস্য যিনি আমার কাছে ভগবান তুল্য।আর দুই হচ্ছে ওই স্কুলের হেডমাস্টার। আমি ফোন করে তাদের সাথে কথা বলে তোমাদের জানাচ্ছি। তবে এটাও আমি জানি তারা কেউই আমায় 'না' বলবেন না। সারারাতের ট্রেন ধকল গেছে তোমাদের। মামনি তোমাদের সব দেখিয়ে দেবে তোমরা স্নান করে ফ্রেস হয়ে নাও। একটু টিফিন করো। দুপুরে যা আছে একটু ডাল,ভাত খেয়ে নেবে।

  ছোট্ট একটা টেবিলে সুজয়,পিসি আর শ্রেষ্ঠাকে দীপিকা ডাল, আলুসিদ্ধ,ফুল কফির তরকারি দিয়ে খুব সুন্দরভাবে সাজিয়ে খেতে দেয়। সুজয়ের সাথে বারবার চোখাচোখি হলেও সে কোন কথা বলে না। সুজয়ও অপরাধীর মত খুবই চুপচাপ থেকে খেয়ে উঠে যায়। মাঝে মধ্যে সে মেয়ের সাথে দু'একটা কথা বলছে শুধু। দুটো ঘর হলেও খাট একটাই। পিসিকে খাটের উপর শুতে বললে উনি বলেন,
-- তুই সুজয়কে আর মেয়েকে খাটে শুতে দে।আমাকে নিচুতে একটা মাদুর পেতে দে। 
-- না,তোমার বয়স হয়েছে তুমি খাটে শোও।
  কথাগুলি সুজয়ের কানে যাওয়াতে সুজয় এগিয়ে গিয়ে বলল,
-- পিসিমা আমি তো একটু বেরোব টিকিটের ব্যাপারে। এখন শোবো না। শুলেই ঘুমিয়ে পড়বো। আপনি বরং খাটে শুয়ে পড়ুন।
  দুপুরে রান্না করতে করতেই দীপিকা ফোনে কথা সেরে নেয়। হেড মাস্টার মহাশয় সঙ্গে সঙ্গেই রাজি হয়ে যান। আর সৌম্য কিছুটা অবাক হয়ে তাকে বলে ---

ক্রমশ