একদিন ভালোবাসবে (৬৫ পর্ব)
দীপিকা কলকাতা আসছে শুনে সৌম্য অবাক হয়ে যায়। সে জানতে চায়
-- কলকাতা আসছো? কিন্তু তুমি তো বলেছিলে তোমার কেউ নেই
দীপিকা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে,
-- নিরুপায় হয়ে মিথ্যে বলতে হয়েছিলো। কিন্তু মা অর্থাৎ তোমার মা সব জানতেন। তাকে আমি একটি কথাও মিথ্যে বলিনি। তিনিই আমায় বারন করেছিলেন প্রকৃত সত্যতা কাউকে না জানাতে।
-- তাহলে তো আমার কিছু বলার নেই। কে কে আছেন তোমার পরিবারে সেটা কি এখন বলা যাবে?
-- মা,বাবা দু'জনেই আছেন।
-- বিশেষ কেউ?
দীপিকা চুপ করে আছে দেখে সৌম্য বললো,
-- আচ্ছা ঠিক আছে।বলতে হবে না। কলকাতা এসে ফোন করো দেখা করবো। ওখানে একা একা থাকার চেয়ে আমার মনেহয় কলকাতায় থাকা অনেক ভালো।
ভেবে দেখো। মনে রাখবে যেখানেই থাকো না কেন সব সময় আমি সাথে আছি।
খুবই কষ্ট করে সুজয় সেদিন টিকিট জোগাড় করে। রিজার্ভেশন কনফার্ম না হলেও তারা ট্রেনে চেপে বসে। অনেক কষ্টে তারা পরদিন কলকাতায় পৌঁছায়। বাড়িতে যখন তারা পৌঁছায় তখনও দীপিকার বাবার জ্ঞান আছে। সুজয় রাস্তা থেকেই নিজের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।।দীপিকা তার দিকে তাকিয়ে শুধু বলে, "থ্যাঙ্কস" । সুজয় তার মুখের দিকে তাকিয়ে পড়লে সে চোখ নামিয়ে মেয়ের হাত ধরে বাড়ির দিকে রওনা দেয়।
বাড়িতে পৌঁছেই দৌড়ে বাবার ঘরে ঢুকে বাবার বুকের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। তার সে আকুল কান্না দেখে বাড়িতে উপস্থিত অন্য সকলের চোখেও জলের ধারা নামে। বাবার মুখের কাছে মুখটা নিয়ে বলে,
-- বাবা, আমি তোমার দীপু। আমায় চিনতে পারছো। আমায় ক্ষমা করে দাও বাবা। আমি স্বার্থপরের মত নিজের কথাই ভেবেছি শুধু। তোমাদের আমি খুব কষ্ট দিয়েছি। আমি জানি এ অপরাধের কোন ক্ষমা হয় না। কিন্তু তোমরা আমায় ক্ষমা না করলে স্বয়ং ঈশ্বর আমার অপরাধের ক্ষমা করবেন না।
দীপিকার বাবার ঠোঁট দুটো কেঁপে উঠলো। চোখের কোল বেয়ে দুফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো। মুখের কোণে মৃদু হাসি নিয়ে মুখটা হা করলেন। পিসিমা এগিয়ে এসে একটা চামচে জল নিয়ে দীপিকার হাতে দিয়ে বললেন,
-- একটু একটু করে দাদার মুখে এই জলটা দে।
দীপিকা কাঁদতে কাঁদতেই বাবার মুখে একটু একটু করে পুরো জলটা দিলো তিনি ঢোক গিলে তার একমাত্র আদরের সন্তান দীপুর হাত থেকে পৃথিবী ছাড়ার আগে জল খেলেন। চোখটা আধো খুলে মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। সেই চোখ পরে তার আদরের সন্তান কখনো দীপা আবার কখনো বা দীপু বলে ডাকা মেয়েটি কাঁদতে কাঁদতেই হাত দিয়ে বন্ধ করে দিলো।
বাড়ির সামনে লোকজন ভর্তি। সকলের মাঝে দীপিকা সুজয়কেউ দেখতে পেলো। আসার পর থেকে কেঁদেই চলেছে। যখন সবাই বললো, "দীপা শ্মশানে যাবে মুখাগ্নি করতে -" প্রথমে দীপিকা আপত্তি জানালেও পরে মায়ের কথায় রাজি হয়। ঠিক এই মুহূর্ত থেকেই দীপিকার ভিতর অদ্ভুত এক শক্তি কাজ করতে থাকে। সে ভাবতে থাকে এতদিন সে যা অন্যায় করেছে তার বাবা,মায়ের প্রতি একটু একটু করে তার সব অন্যায়ের মাসুল তাকেই দিতে হবে। আজ বাবা নেই। মায়ের সব দায়িত্ব তাকেই নিতে হবে। মাকে আর সে কষ্ট পেতে দেবে না। একমাত্র সন্তান হয়েও সে এতদিন তাদের যে কষ্ট দিয়েছে তার কোনই অধিকার ছিল না তাদের এই কষ্ট দেওয়া। দীপিকার এখন মনে হচ্ছে এতগুলো বছর সে যেন একটা ঘোরের ভিতর ছিলো।
শ্মশানের যাবতীয় কাজ সে নিষ্ঠার সাথে পালন করে গঙ্গায় স্নান সেরে নতুন বস্ত্র পরে বাড়ি আসে। বাড়িতে ফেরার পর এই প্রথম সে মায়ের বুকের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে কাঁদতে কাঁদতে বলে,
-- আমায় ক্ষমা করে দাও মা। আজ আমি মা হয়ে বুঝতে পেরেছি তোমার আর বাবার প্রতি আমি কী অন্যায় করেছি। তখন শুধুই নিজের কথাই ভেবেছি। তোমাদের কষ্ট,তোমাদের দুঃখ এসব মাথায় ছিলো না। আমার জন্যই বাবা এত তাড়াতাড়ি আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। এ কষ্ট আমি কোনদিন ভুলতে পারবো না।
দীপিকার মা মেয়ের এ আকুল কান্নার মাঝেও নিজেকে সংযত রেখে মেয়ের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলেন,
--- যা হয়ে গেছে তা নিয়ে ভেবে লাভ নেই। তোর বাবার এ টুকুই আয়ু ছিলো। শান্তনা একটাই তিনি চলে যাওয়ার আগে তোকে দেখে গেছেন। কিন্তু তোর কাছে আমার অনেক কিছু জানার আছে।
-- বলবো মা তোমাকে সব বলবো। তোমাকে একা রেখে আর আমি যাবো না। আমার ভুলের মাসুল সারাজীবন ধরে দেবো। কিন্তু তোমাকে আর আমি কষ্ট পেতে দেবো না। আমার জন্য এতগুলো বছর তুমি আর বাবা অনেক কষ্ট পেয়েছ।
-- ওসব কথা ছার কী ঘটেছিল কেন কাউকে কিছুই না বলে এভাবে পালিয়ে গেলি? আমরা তো তোর পছন্দ করা ছেলের সাথেই তোর বিয়ে ঠিক করেছিলাম। তারপর কাকে তুই বিয়ে করলি সব আমায় জানা। দিদিভাইয়ের বাবার নাম কী? সে কোথায়? তুই শাঁখা,সিঁদুর পরিস না কেন?
মায়ের এতগুলো প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে চোখের জল মুছে দীপিকা মায়ের সামনে শক্ত হয়ে বসে।
ক্রমশ