Monday, January 16, 2023

বিধান (নূতন)

 অফিস থেকে বেরোতে নির্মলেন্দুবাবুর বেশ অনেকটাই আজ দেরি হয়ে যায়।অবশ্য শুধু তিনি একাই নন আজ বেশ কয়েকটি মিটিং থাকার ফলে তার সাথে আরো চার,পাঁচজন ছিলেন।কিন্তু কী আর করা যাবে কাজগুলো শেষ না করে তো আসা যায় না। অফিস থেকে বাড়ির রাস্তা গাড়িতে প্রায় ঘণ্টা দেড়েক। ফাঁকা রাস্তায় গাড়ি চালাতে চালাতে হঠাৎ তার নজরে পড়ে ফুটপাথে  একটা গাছের নীচে একজন শুয়ে আছেন আর তার পাশে বসে তারস্বরে একটি বাচ্চা কেঁদে চলেছে।গাড়ির আওয়াজে হয়ত সেই চিৎকার তার কানে আসতো না।কিন্তু ঠিক সেই জায়গাটাতেই তিনি ট্রাফিক সিগন্যালে আটকে গেছিলেন। গাড়ির জানালা দিয়ে কিছুক্ষণ বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে থেকে কী ভেবে তিনি গাড়িটা কিছুদূর এগিয়ে পার্ক করে বাচ্চাটার কাছে এগিয়ে যান।বাচ্চা মেয়েটিকে দেখে মনেহল বছর চারেক বয়স হবে।বেশ কয়েকবার শুয়ে থাকা ভদ্রমহিলার গায়ে ধাক্কা দিয়ে ডাকেন।তারপর নাড়ি দেখে বুঝতে পারেন তিনি আর নেই। ওখানে দাঁড়িয়েই একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সাথে যোগাযোগ করেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা সেখানে হাজির হয়ে যায়।বাচ্চা মেয়েটিকে কোলে তুলে গাড়িতে করে নিজের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেন।পুরো রাস্তাটাই সে কাঁদতে কাঁদতে আসে।
 দুই সন্তানের পিতা যখন ফুটপাথের একটি মেয়েকে কোলে নিয়ে নিজের বাড়িতে ঢোকেন তখন তার স্ত্রী সুস্মিতা বেশ অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকেন।তিনি তার স্ত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে বলেন,
--- সব প্রশ্নের উত্তর তোমাকে দেবো।কিন্তু তুমি আগে একটু গরম দুধ এনে বাচ্চাটিকে খাইয়ে দাও তো।সুস্মিতা কোন প্রশ্ন না করেই দুধ এনে স্বামীর কোল থেকে বাচ্চাটিকে নিয়ে দুধ খাওয়াতে খাওয়াতে স্বামীর মুখ থেকে পুরো ঘটনাটা শুনলেন এবং বললেন,
--- তাহলে এখন কী হবে?
--- কী আর হবে? দুটো ছেলে আছে আর একটা মেয়ে হল।
--- কিন্তু আইনী কাগজপত্র?
--- ভেবো না ওসব আমি সামলে নেবো।
 বাচ্চা মেয়েটিকে দেখলে কে বলবে যে তার জন্ম ফুটপাথে।যেমন স্বাস্থ্য ঠিক তেমন সুন্দর দেখতে। মাথা ভর্তি কোকড়ানো চুল।শুধু মলিন একটা জামা পরা।
চুকচুক করে এক নিমেষে সে গ্লাসের দুধটা শেষ করে সুস্মিতার কোলেই ঘুমে ঢলে পড়লো।সুস্মিতা হাত দিয়ে বাচ্চাটার মুখের উপর থেকে  চুলগুলো সরিয়ে দিয়ে বললো,
--- ভগবান আছেন তাই তো আজ তোমাকে তিনি ওর কাছে নিয়ে গেছেন। কাল কিছু জামাকাপড় কিনে এনে তারপর অফিস যেও। আর যা যা করণীয় তাই কোরো ওকে আইনীভাবে আমাদের পেতে।
  সাত বছর ও দশ বছরের দুটি সন্তানের সাথে নির্মলেন্দুবাবু ও সুস্মিতার আদরের মেয়ে পরমাও বেশ আদরেই বড় হতে থাকে।মানুষ কথাই বলে, "জন্ম হোক যথাতথা কর্ম হোক ভালো"- পরমার ক্ষেত্রেও ঠিক তাই।বিধাতা তার ভাগ্যটাকে এভাবেই লিখেছিলেন।
    অনেক ঝড়ঝাপটা পেরিয়ে পাড়াপ্রতিবেশীর কথার জ্বালে জড়াবেন না বলেই সেখানকার বাড়ি বিক্রি করে দিয়ে অফিস যাতায়াতের সুবিধা হবে এই কথা বলে অন্যত্র ফ্ল্যাট কিনে চলে যান।তার ছেলে দুটিও পরমাকে নিজের বোন বলেই মেনে নিয়েছে।     নির্মলেন্দুবাবু আর সুস্মিতার ছেলেমেয়েগুলো আজ মানুষের মত মানুষ হয়েছে।বড় ছেলে প্রফেসর, ছোটটি ইঞ্জিনিয়ার আর পরমা বেশ নাম করা একজন ফ্যাশান ডিজাইনার।
 সময় এগিয়ে চলে চোখের পলকে। ছেলেদুটির বিয়ের পরেই সংসারে খুঁটিনাটি অশান্তি হতেই থাকে।কেউই আর বাবা,মায়ের কাছে দুদণ্ড বসে কথা বলার সময় পায় না। পরমা তার কাজের জন্য নানান সময়ে বাইরেই থাকে। কিন্তু বাইরে থেকে এসেই সে মাকে বিশ্রাম দিতে কাজে লেগে পড়ে। রান্নারমাসীর রান্না করে রেখে যাওয়া খাবার গরম করে তাদের খেতে দেওয়া থেকে শুরু করে দু'জনের ওষুধটাও হাতে তুলে দেয়।এখন আর ছেলেরা কেউই কাছে থাকে না। নিত্য অশান্তির হাত থেকে মুক্তি পেতে তারা এবাড়ি ছেড়ে তাদের বউ,বাচ্চা নিয়ে অন্যত্র থাকে। বুড়ো, বুড়ির এখন পরমাই ভরসা। অনেক চেষ্টা করেও মেয়েকে বিয়েতে রাজি করাতে পারেননি।তার এক কথা আমি চলে গেলে তোমাদের কে দেখবে? আর যখনই সে একথা বলে স্বামী,স্ত্রী বুকচেরা এক দীর্ঘনিশ্বাসের সাথে দু'জন দু'জনের মুখের দিকে তাকান। কিন্তু তবুও তারা একে ওকে বলতেই থাকেন পরমার বিয়ের জন্য ছেলে দেখতে।
 কিছুদিন ধরেই সুস্মিতার শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। পরমা তাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে ছুটাছুটি করছে।নানান পরীক্ষা নিরীক্ষায় জানা গেলো কিডনী দু'টোই খারাপ হয়ে গেছে। ছেলেদের খবর দেওয়া হল। তারা এসে কিছু জ্ঞান দিয়ে চলে গেলো। কিন্ডনী ট্রান্সপ্লান্ট এর জন্য নানান জায়গায় চেষ্টা করা হচ্ছে কিন্তু হাতে সময় খুব কম। প্রচুর টাকার বিনিময়েও কোন লোক পাওয়া যাচ্ছে না।পরমা আর কোন উপায় না দেখে তার মাকে বাঁচাতে নিজেই কিডনী দেবে ঠিক করে।বাবা,মাকে না জানিয়ে তার পরীক্ষানিরীক্ষা চলতে থাকে।আশ্চর্যের বিষয় সমস্ত পরীক্ষায় পরমা উৎরে যায়।সব কাজ সেরে যখন সে বাবাকে এসে বললো তখন বাবা বেঁকে বসলেন।তিনি কিছুতেই রাজি নন।পরমা অনেক চেষ্টা করলো বাবাকে বোঝাতে শেষে না পেরে বলে উঠলো,
--- তোমরা আমার জন্য যা করেছো তার ঋণ পুরো জীবন দিয়ে দিলেও শোধ হবে না --
 নির্মলেন্দুবাবু কেঁপে উঠলেন। পরমা কী সব জেনে গেলো?
-- কী বলছিস তুই? আমি বুঝতে পারছি না --
-- বাবা,আমি সব জানি।
--- কী জানিস আর কী করেই বা জানলি? আমরা তো তোকে কিছু কখনো বলিনি। আর তখন তো তুই খুব ছোট ছিলি। তোর মনে থাকার কথাও নয়। তুই আমাকে বল কে তোকে বলেছে এসব কথা।
--- দেখো বাবা, আমাকে মানুষ করেছো বলেই নয়।তুমি আমাকে জন্ম দিলেও আজ মায়ের এই অসুস্থতায় আমি এই সিদ্ধান্তই নিতাম।
-- সেসব পড়ে হবে।তুই আমাকে আগে বল একথা তোকে কে বলেছে?
--- আমাকে কেউ বলেনি বাবা।যেদিন বড়দা ঝামেলা করে বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছিলো সেদিন তার ঘরে খুব চিৎকার করে করে বৌদিকে বলছিলো," রাস্তায় পড়ে থাকা এক ভিখারীর মেয়ের জন্য দরদ উথলে পড়ছে। যেদিন বাড়িঘর সব লিখিয়ে নিয়ে বাবা,মাকে রাস্তায় বসিয়ে দেবে সেদিন এই ছেলের দরজাতেই আসতে হবে।"
 নির্মলেন্দুবাবু একটা দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে ধপ করে সোফায় বসে পড়লেন। পরমা বাবার কাছে এগিয়ে তার হাতদু'টি ধরে বললো,
--- বিশ্বাস করো বাবা এরজন্য আমার একটুও কষ্ট নেই।বরং সেদিনের পর থেকে তোমাদের প্রতি আমার শ্রদ্ধা,ভালোবাসা দুইই বেড়ে গেছে।
 নির্মলেন্দুবাবু তার আদরের কন্যার মাথায় হাত বুলাতে লাগলেন আর চোখ থেকে তার জল গড়িয়ে পড়তে লাগলো।
                    শেষ
 
 
 

No comments:

Post a Comment