Monday, January 16, 2023

একদিন ভালোবাসবে (তৃতীয় পর্ব)

একদিন ভালোবাসবে ( তৃতীয় পর্ব)


  সেদিন কলেজ পিকনিকে বিকেল বেলায় চা,টিফিন হয়ে যাওয়ার পর সবাই গিয়ে বাসের ভিতর উঠে বসলো। শ্রাবণীর গায়ে নিলয়ের জ্যাকেটটা দেখে কেউ টেরিয়ে দেখলো আবার কেউ বা সরাসরিই জানতে চাইলো ব্যাপারটা কত দুর গড়িয়েছে? কিন্তু শ্রাবণী কিংবা তার সাথে থাকা বন্ধুটি একদম মুখে কুলুপ এঁটে রয়েছে।একই সাথে নিলয়রাও। নিলয় ও শ্রাবণী একই সাথে বাসে উঠে আর উঠেই শ্রাবণী জানলার দিকের একটি ছিট দখল করার সাথে সাথেই টুক করে নিলয় তার পাশে বসে পড়ে। কেউ একটু আড় চোখে দেখলো আবার কেউবা একটু হাসলো। শুরু করলো নিজেদের মধ্যে গুঞ্জন।বাসটা কিছুটা এগিয়ে যাওয়ার পর নিলয় মুখ নিচু করে খুব আস্তে দুরুদুরু বুক নিয়ে শ্রাবণীর কাছে জানতে চাইলো,
--- কী বলবি বলেছিলি?
 শ্রাবণী নিলয়ের দিকে তাকিয়ে বললো,
--- হ্যাঁ বলছি,আমার বাবা ভীষণ রাগী মানুষ। এই জ্যাকেটটা পরে আমি যদি বাড়ি ফিরি তাহলে আমার বাইরে বেরোনো এমনকি পড়াশুনায় হয়ত বন্ধ করে দেবেন।কিন্তু জ্যাকেট ছাড়া রাস্তা থেকে বাড়িতে যাওয়ায় মুস্কিল।এদিকে আমার জামাটা কিছুটা ছিঁড়ে গেছে উপরন্তু ওড়নাটাও নেই।এভাবে বাড়ি ঢুকলে বাবা আমায় আস্ত রাখবেন না।আমি একটা ওড়না কিনবো।তুই আমার সাথে একটু দোকানে যাবি। ওড়নাটা কিনে তোর জ্যাকেটটা দিয়ে দেবো।
 নিলয়ের এতক্ষণ পরে বুকের ধুকপুকানি বন্ধ হল।মনেমনে একটু হেসেও নিলো।তারপর বললো,
--- ওকে কোন সমস্যা নেই।
 দু'জনে একসাথে বাস থেকে নেমে একটা দোকান থেকে ওড়না কিনে একটু ফাঁকা জায়গা দেখে সেখানে দাঁড়িয়ে শ্রাবণী তার গায়ের থেকে জ্যাকেটটা খুলে ওড়নাটাকে গায়ে চাপিয়ে জ্যাকেটটা নিলয়ের হাতে তুলে দিতে দিতে বলল,
-- যেখানেই থাকি না কেন আজকে তোর এই উপকারের কথা জীবনেও ভুলবো না।
 নিলয় এ কথা শুনে একটু মুচকি হেসে দিয়ে বললো,
--- সাবধানে যাস।
  বাড়ি ফেরার পথে নিলয় সেদিন সারাটা রাস্তা নিজের মনেই হেসেছে। নিজের নির্বুদ্ধিতায় নিজেকেই দোষারোপ করেছে।

      নিলয় সেই সন্ধ্যায় বেরিয়েছে তারপর বাবা,মা মিলে তাকে বেশ কয়েকবার ফোন করেছেন প্রতিবারই সে একই উত্তর দিয়েছে হাসপাতালে আছি বাড়ি গিয়ে সব বলছি। রাত এগারোটা।নিলয়ের দেখা নেই।তিতাসা জোর করে বাবা,মাকে খাইয়ে দেয়।ড্রয়িং কাম ডাইনিংয়ের সোফায় বসে থাকতে থাকতে তিয়াসার চোখদুটো ঘুমে জড়িয়ে আসে।হঠাৎ কলিং বেলের আওয়াজে সে দৌড়ে গিয়ে দরজা খোলে। উষ্কখুষ্ক চুল উদভ্রান্তের মত নিলয় ঘরে ঢোকে।ঘরে ঢুকেই সে সরাসরি উপরে উঠে গিয়ে কিছুক্ষনের মধ্যে ফ্রেস হয়ে টেবিলে খেতে বসে। তিয়াসা নিলয়ের খাবার সামনে গুছিয়ে দিয়ে নিজে একটা চেয়ার টেনে বসে। সেটা দেখতে পেয়ে নিলয় বলে,
--- তোমার বসে থাকার কোন দরকার নেই।আমি খেয়ে বাকি খাবার সব ফ্রিজে তুলে দেবো।
 ঠিক এই সময়ে নীলিমা খাবার টেবিলের কাছে দাঁড়িয়ে বলেন,
--- সেই সন্ধ্যায় বেড়িয়েছিস এত রাত করে ফিরলি মেয়েটা আমাদের খাইয়ে দিয়ে নিজে না খেয়ে তোর জন্য বসে আছে। তুই এসে খেতে বসে গেলি।একবারও জানতে চাইলি না সে খেয়েছে কিনা? উপরন্তু বলছিস তাকে চলে যেতে?
নিলয় অবাক হয়ে স্ত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে বলে,
-- এত রাত পর্যন্ত না খেয়ে কেন বসে আছো? তুমি খাবে তোমার খিদেতে।ওসব দিন চলে গেছে যে স্বামীর জন্য না খেয়ে বসে থাকতে হবে।আমি এসব একদম পছন্দ করি না।নিজের খাবার নিয়ে খেতে বসো।
 কোন কথার উত্তর না দিয়ে তিয়াসা ঠাঁই বসে আছে দেখে নিলয় নিজেই একটা থালায় ভাত গুছিয়ে তার সামনে দেয়। এটা দেখতে পেয়ে নীলিমা সেখান থেকে দ্রুত চলে আসেন।এরপর নিলয় নিজেই তিয়াসার থালায় ডাল আর ভাজা তুলে দিয়ে বলে
-- অনেক রাত হল খেতে শুরু কর।
-- আমার যে তোমার কাছ থেকে অনেক কথা জানার আছে।
-- বলবো সব বলবো।একটু সময় দাও আমায়।তুমি মনেমনে যত খারাপ আমায় ভাবছো ঠিক ততটা খারাপ আমি নই। আমার জীবনের উপর থেকে একটা ঝড় বয়ে গেছে।সবকিছু তছনছ হয়ে আছে।নিজেকে একটু গুছিয়ে নিতে সময় দাও।আজ সারাটা সন্ধ্যা কেটেছে আমার হাসপাতালে।আমার পরিচিত একটি মেয়ে সুইসাইড অ্যাটেম করতে গিয়েছিল। তাকে নিয়েই সারাটাদিন ছুটোছুটি করেছি।না,না তুমি অন্য কিছু ভেবো না।ওকে আমি নিজের বোনের মত ভালোবাসি।
    তিয়াসা সে কথার কোন উত্তর দেয় না। ডাল দিয়ে ভাত মেখে নিয়ে নাড়াচাড়া করতে লাগে। দেখতে পেয়ে নিলয় বলে ওঠে,
--- থালায় ভাত নিয়ে শুধু নাড়িয়ে গেলেই পেট ভরবে না।আমি জানি তোমার মনে অনেক প্রশ্ন ভির করে আছে। বিয়েটা আমার ইচ্ছায় হয়নি অনুরোধে হয়েছে। হ্যাঁ বলতেই পারো কারো অনুরোধে তোমার জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে আমি পারি না।অস্বীকার করছি না। দায়িত্ব যখন তোমার নিয়েছি তা পালনও করবো।শুধু একটু সময় চাইছি।
 কথা শেষ করে তিয়াসার থালায় ঝোল সহ একটা বড় মাছের টুকরো তুলে দেয় নিলয়। তিয়াসা নিলয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে পরে।তার চোখের জল নিলয়ের চোখ এড়ায় না। কিন্তু দেখেও না দেখার ভান করে নিজের খাবারের দিকে মন দেয়। ভাবতে থাকে সত্যিই তো তার জীবনের এই জটিলতার জন্য সে আর একটি মেয়ের জীবন নষ্ট করতে পারে না। তবে যতদিন আদালতে কেস চলতে থাকবে সে কিছুতেই তিয়াসার সাথে স্বাভাবিক হতে পারবে না। কেসটা মিটে গেলেই সে সবকিছু জানিয়ে দেবে তিয়াসাকে। এই কেসের ব্যাপারে এখনো পর্যন্ত নিজের বাবা,মাকেও কিছু জানায়নি সে। তারা যখন বিয়ের জন্য মেয়ে দেখছেন সে বারবার আপত্তি জানিয়েছিল।কিন্তু কিছুতেই কারণটা বলতে পারেনি। তাই তারাও তাদের ছেলের আপত্তিতে কান দেননি। 
  নিলয় খেয়ে উপরে উঠে যায়। তিয়াসা টেবিল মুছে,খাবার ফ্রিজে দিয়ে যখন উপরে নিজের ঘরে ঢোকে তখন দেখে খাটের উপর শুয়ে নিলয় ঘুমিয়ে পড়েছে। ভালো করে গায়ে কম্বলটা দিয়ে ভাবতে থাকে গতকাল ফুলশয্যার খাটে না শুয়ে নিলয় সোফায় ঘুমিয়েছে। সে নিশ্চয়ই চায় না দু'জনে খাটে শুতে। তাই আস্তে করে নিলয়ের মাথার কাছ থেকে নিজের বালিশটা নিয়ে সোফায় শুয়ে পরে বাবার বিয়েতে দেওয়া ব্লাঙ্ককেটটা নিয়ে।কিন্তু কিছুতেই তার ঘুম আসে না। আগামীকাল আবার দ্বীরাগমনে যাওয়ার কথা। নিলয়ের সাথে মনের মিল না হলেও এই একদিনেই সে বুঝে গেছে মানুষটা মোটেই খারাপ নয়। কিন্তু কী যে মানুষটার সমস্যা সেটাই তো সে বলছে না। কাল যদি আবার ভোরে বেরিয়ে গিয়ে এত রাত করে ফেরে? তাহলে দ্বিরাগমনে তো যাওয়া হবে না।ওদিকে বাবা, মা,বোন বাজার রান্নাবান্না করে অপেক্ষা করতে থাকবেন। বাড়ির নানান কথা মনে পড়তে থাকে। নিজের জীবনে যা ঘটে গেছে সেটাকে মেনে নেওয়া ছাড়া আর কোন পথ নেই। কিন্তু বাবাকে বোঝাতেই হবে পিয়াসাকে সাত তাড়না করে বিয়ে দেওয়ার কোন প্রয়োজন নেই।আগে ও হায়ার এডুকেশন নিয়ে একটা চাকরী পাক তারপর নাহয় বিয়ের কথা ভাবা যাবে। এইসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে ভোরের দিকে তিয়াসা ঘুমিয়ে পরে।
  এক ঘুমেই নিলয়ের ভোর হয়ে যায়।সে ঘুম থেকে জেগে দেখে তিয়াসা গুটিসুটি হয়ে সোফায় ঘুমিয়ে আছে। বড্ড মায়া হয় তার। মেয়েটার তো কোন দোষ নেই। কিন্তু সে যে কিছুতেই ওর কাছে ফ্রী হতে পারছে না। খামোখা একটা ঝামেলায় ফেঁসে গিয়ে নিজের জীবনের সুখশান্তি নষ্ট হয়ে গেলো। হঠাৎ নিলয়ের মনে পড়লো আজ আবার দ্বীরাগমনে শ্বশুরবাড়ি যেতে হবে।নিয়ম আর রিচুয়ালের চক্রবুহে আজ প্রায় সাতদিন ধরে প্রাণ ওষ্ঠাগত। তবুও বাবা,মায়ের মুখ চেয়ে সবই করে যেতে হচ্ছে। সে উঠে বাথরুমে ঢোকে।আর দরজা দেওয়ার শব্দে তিয়াসার ঘুম ভেংগে যায়। নিলয় বাথরুম থেকে বেরিয়ে দেখে বিছানা,সোফা সুন্দরভাবে গুছিয়ে তিয়াসা জানলা দিয়ে অন্যমনস্কভাবে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। নিলয় যে বাথরুম থেকে ঘরে ঢুকেছে সে টের পায়নি। নিলয় ইচ্ছাকৃত ড্রেসিংটেবিলের কাছে দাঁড়িয়ে একটু শব্দ করে। তিয়াসা ঘাড় ঘুরিয়ে নিলয়কে দেখে দ্রুত পায়ে বাথরুমের দিকে এগিয়ে যায়। পিছন থেকে নিলয় বলে ওঠে,
-- একটা কথা ছিলো ---

ক্রমশ --


 

বিধান (নূতন)

 অফিস থেকে বেরোতে নির্মলেন্দুবাবুর বেশ অনেকটাই আজ দেরি হয়ে যায়।অবশ্য শুধু তিনি একাই নন আজ বেশ কয়েকটি মিটিং থাকার ফলে তার সাথে আরো চার,পাঁচজন ছিলেন।কিন্তু কী আর করা যাবে কাজগুলো শেষ না করে তো আসা যায় না। অফিস থেকে বাড়ির রাস্তা গাড়িতে প্রায় ঘণ্টা দেড়েক। ফাঁকা রাস্তায় গাড়ি চালাতে চালাতে হঠাৎ তার নজরে পড়ে ফুটপাথে  একটা গাছের নীচে একজন শুয়ে আছেন আর তার পাশে বসে তারস্বরে একটি বাচ্চা কেঁদে চলেছে।গাড়ির আওয়াজে হয়ত সেই চিৎকার তার কানে আসতো না।কিন্তু ঠিক সেই জায়গাটাতেই তিনি ট্রাফিক সিগন্যালে আটকে গেছিলেন। গাড়ির জানালা দিয়ে কিছুক্ষণ বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে থেকে কী ভেবে তিনি গাড়িটা কিছুদূর এগিয়ে পার্ক করে বাচ্চাটার কাছে এগিয়ে যান।বাচ্চা মেয়েটিকে দেখে মনেহল বছর চারেক বয়স হবে।বেশ কয়েকবার শুয়ে থাকা ভদ্রমহিলার গায়ে ধাক্কা দিয়ে ডাকেন।তারপর নাড়ি দেখে বুঝতে পারেন তিনি আর নেই। ওখানে দাঁড়িয়েই একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সাথে যোগাযোগ করেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা সেখানে হাজির হয়ে যায়।বাচ্চা মেয়েটিকে কোলে তুলে গাড়িতে করে নিজের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেন।পুরো রাস্তাটাই সে কাঁদতে কাঁদতে আসে।
 দুই সন্তানের পিতা যখন ফুটপাথের একটি মেয়েকে কোলে নিয়ে নিজের বাড়িতে ঢোকেন তখন তার স্ত্রী সুস্মিতা বেশ অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকেন।তিনি তার স্ত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে বলেন,
--- সব প্রশ্নের উত্তর তোমাকে দেবো।কিন্তু তুমি আগে একটু গরম দুধ এনে বাচ্চাটিকে খাইয়ে দাও তো।সুস্মিতা কোন প্রশ্ন না করেই দুধ এনে স্বামীর কোল থেকে বাচ্চাটিকে নিয়ে দুধ খাওয়াতে খাওয়াতে স্বামীর মুখ থেকে পুরো ঘটনাটা শুনলেন এবং বললেন,
--- তাহলে এখন কী হবে?
--- কী আর হবে? দুটো ছেলে আছে আর একটা মেয়ে হল।
--- কিন্তু আইনী কাগজপত্র?
--- ভেবো না ওসব আমি সামলে নেবো।
 বাচ্চা মেয়েটিকে দেখলে কে বলবে যে তার জন্ম ফুটপাথে।যেমন স্বাস্থ্য ঠিক তেমন সুন্দর দেখতে। মাথা ভর্তি কোকড়ানো চুল।শুধু মলিন একটা জামা পরা।
চুকচুক করে এক নিমেষে সে গ্লাসের দুধটা শেষ করে সুস্মিতার কোলেই ঘুমে ঢলে পড়লো।সুস্মিতা হাত দিয়ে বাচ্চাটার মুখের উপর থেকে  চুলগুলো সরিয়ে দিয়ে বললো,
--- ভগবান আছেন তাই তো আজ তোমাকে তিনি ওর কাছে নিয়ে গেছেন। কাল কিছু জামাকাপড় কিনে এনে তারপর অফিস যেও। আর যা যা করণীয় তাই কোরো ওকে আইনীভাবে আমাদের পেতে।
  সাত বছর ও দশ বছরের দুটি সন্তানের সাথে নির্মলেন্দুবাবু ও সুস্মিতার আদরের মেয়ে পরমাও বেশ আদরেই বড় হতে থাকে।মানুষ কথাই বলে, "জন্ম হোক যথাতথা কর্ম হোক ভালো"- পরমার ক্ষেত্রেও ঠিক তাই।বিধাতা তার ভাগ্যটাকে এভাবেই লিখেছিলেন।
    অনেক ঝড়ঝাপটা পেরিয়ে পাড়াপ্রতিবেশীর কথার জ্বালে জড়াবেন না বলেই সেখানকার বাড়ি বিক্রি করে দিয়ে অফিস যাতায়াতের সুবিধা হবে এই কথা বলে অন্যত্র ফ্ল্যাট কিনে চলে যান।তার ছেলে দুটিও পরমাকে নিজের বোন বলেই মেনে নিয়েছে।     নির্মলেন্দুবাবু আর সুস্মিতার ছেলেমেয়েগুলো আজ মানুষের মত মানুষ হয়েছে।বড় ছেলে প্রফেসর, ছোটটি ইঞ্জিনিয়ার আর পরমা বেশ নাম করা একজন ফ্যাশান ডিজাইনার।
 সময় এগিয়ে চলে চোখের পলকে। ছেলেদুটির বিয়ের পরেই সংসারে খুঁটিনাটি অশান্তি হতেই থাকে।কেউই আর বাবা,মায়ের কাছে দুদণ্ড বসে কথা বলার সময় পায় না। পরমা তার কাজের জন্য নানান সময়ে বাইরেই থাকে। কিন্তু বাইরে থেকে এসেই সে মাকে বিশ্রাম দিতে কাজে লেগে পড়ে। রান্নারমাসীর রান্না করে রেখে যাওয়া খাবার গরম করে তাদের খেতে দেওয়া থেকে শুরু করে দু'জনের ওষুধটাও হাতে তুলে দেয়।এখন আর ছেলেরা কেউই কাছে থাকে না। নিত্য অশান্তির হাত থেকে মুক্তি পেতে তারা এবাড়ি ছেড়ে তাদের বউ,বাচ্চা নিয়ে অন্যত্র থাকে। বুড়ো, বুড়ির এখন পরমাই ভরসা। অনেক চেষ্টা করেও মেয়েকে বিয়েতে রাজি করাতে পারেননি।তার এক কথা আমি চলে গেলে তোমাদের কে দেখবে? আর যখনই সে একথা বলে স্বামী,স্ত্রী বুকচেরা এক দীর্ঘনিশ্বাসের সাথে দু'জন দু'জনের মুখের দিকে তাকান। কিন্তু তবুও তারা একে ওকে বলতেই থাকেন পরমার বিয়ের জন্য ছেলে দেখতে।
 কিছুদিন ধরেই সুস্মিতার শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। পরমা তাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে ছুটাছুটি করছে।নানান পরীক্ষা নিরীক্ষায় জানা গেলো কিডনী দু'টোই খারাপ হয়ে গেছে। ছেলেদের খবর দেওয়া হল। তারা এসে কিছু জ্ঞান দিয়ে চলে গেলো। কিন্ডনী ট্রান্সপ্লান্ট এর জন্য নানান জায়গায় চেষ্টা করা হচ্ছে কিন্তু হাতে সময় খুব কম। প্রচুর টাকার বিনিময়েও কোন লোক পাওয়া যাচ্ছে না।পরমা আর কোন উপায় না দেখে তার মাকে বাঁচাতে নিজেই কিডনী দেবে ঠিক করে।বাবা,মাকে না জানিয়ে তার পরীক্ষানিরীক্ষা চলতে থাকে।আশ্চর্যের বিষয় সমস্ত পরীক্ষায় পরমা উৎরে যায়।সব কাজ সেরে যখন সে বাবাকে এসে বললো তখন বাবা বেঁকে বসলেন।তিনি কিছুতেই রাজি নন।পরমা অনেক চেষ্টা করলো বাবাকে বোঝাতে শেষে না পেরে বলে উঠলো,
--- তোমরা আমার জন্য যা করেছো তার ঋণ পুরো জীবন দিয়ে দিলেও শোধ হবে না --
 নির্মলেন্দুবাবু কেঁপে উঠলেন। পরমা কী সব জেনে গেলো?
-- কী বলছিস তুই? আমি বুঝতে পারছি না --
-- বাবা,আমি সব জানি।
--- কী জানিস আর কী করেই বা জানলি? আমরা তো তোকে কিছু কখনো বলিনি। আর তখন তো তুই খুব ছোট ছিলি। তোর মনে থাকার কথাও নয়। তুই আমাকে বল কে তোকে বলেছে এসব কথা।
--- দেখো বাবা, আমাকে মানুষ করেছো বলেই নয়।তুমি আমাকে জন্ম দিলেও আজ মায়ের এই অসুস্থতায় আমি এই সিদ্ধান্তই নিতাম।
-- সেসব পড়ে হবে।তুই আমাকে আগে বল একথা তোকে কে বলেছে?
--- আমাকে কেউ বলেনি বাবা।যেদিন বড়দা ঝামেলা করে বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছিলো সেদিন তার ঘরে খুব চিৎকার করে করে বৌদিকে বলছিলো," রাস্তায় পড়ে থাকা এক ভিখারীর মেয়ের জন্য দরদ উথলে পড়ছে। যেদিন বাড়িঘর সব লিখিয়ে নিয়ে বাবা,মাকে রাস্তায় বসিয়ে দেবে সেদিন এই ছেলের দরজাতেই আসতে হবে।"
 নির্মলেন্দুবাবু একটা দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে ধপ করে সোফায় বসে পড়লেন। পরমা বাবার কাছে এগিয়ে তার হাতদু'টি ধরে বললো,
--- বিশ্বাস করো বাবা এরজন্য আমার একটুও কষ্ট নেই।বরং সেদিনের পর থেকে তোমাদের প্রতি আমার শ্রদ্ধা,ভালোবাসা দুইই বেড়ে গেছে।
 নির্মলেন্দুবাবু তার আদরের কন্যার মাথায় হাত বুলাতে লাগলেন আর চোখ থেকে তার জল গড়িয়ে পড়তে লাগলো।
                    শেষ