কেউ কারো নয়
কতদিন আর মিথ্যে আশ্বাস দিয়ে যাবো --
ব্যালকনি থেকে নন্দিতা উঁকি দিয়ে দেখে গেটের কাছে একটি হলুদ ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে।ফ্ল্যাটটিতে আটটা পরিবার বাস করে।একমাত্র বীরেনবাবুর ছাড়া আর সকলেরই গাড়ি রয়েছে। বীরেনবাবু আর তার স্ত্রী থাকেন দোতলার পশ্চিম দিকের ফ্ল্যাটটিতে।
বীরেনবাবু আর তার স্ত্রীর দু'জনেরই বয়স হয়েছে।ছেলে থাকে আমেরিকায়।বছর দু'য়েক আগে এসে বাপের বিশাল তিনতলা বাড়ি বিক্রি করে বাবা,মায়ের জন্য ছোট্ট দু'কামরার এই ফ্ল্যাটটি কিনে দিয়ে বাকি টাকা পয়সা নিয়ে পুনরায় আমেরিকা চলে গেছেন।যদিও স্বামী,স্ত্রী দেখা হলে প্রায়ই বলে থাকেন ছেলে মাসে মাসে টাকা পাঠায় কিন্তু সেটা যে সত্যি নয় এটা ফ্ল্যাটের অনেকেই বুঝতে পারেন।
মাঝে মাঝে নন্দিতা এটা সেটা রান্না করে যখন তাঁদেরকে দিতে গেছে অধিকাংশ দিনই সে দেখেছে এক তরকারী ভাত করা।প্রথম থেকেই নন্দিতার বয়স্ক এই মানুষ দু'টির প্রতি অদ্ভুত এক মায়া।কেন তা সে নিজেই জানে না।নন্দিতা তার শ্বাশুড়ী ,চার বছরের ছেলে আর স্বামী থাকে তিন তলায়।
বীরেনবাবুর স্ত্রীর হঠাৎ এই বয়সে এসে ধরা পড়ে ব্লাড ক্যান্সার।যেহেতু নন্দিনী বীরেনবাবুর স্ত্রী ললিতাদেবীকে নিয়ে নিজে ডাক্তারের কাছে গিয়েছিল তাই ললিতাদেবী নন্দিনীকে বলেছিলেন,
--- এই বয়সে এসে মানুষটা একথা জানলে বড্ড কষ্ট পাবেন। তাই মা তুমি এই রোগের কথা ওনাকে কিছু জানিও না।কটাদিনই বা আর বাঁচবেন আর আমারও তো সময় শেষ।
নন্দিনী ললিতাদেবীর কথা রেখেছে। সে শুধু বীরেনবাবু কেন ফ্ল্যাটের অন্যান্য বাসিন্দাদেরও অনেকদিন পর্যন্ত কিছু বলেনি।নার্সিংহোমে নিয়ে যাওয়া, ওষুধপত্র কেনা সবই নন্দিনী করে। নন্দিনী বয়স্ক ভদ্রলোকটিকে নিজের বিবেকের বিরুদ্ধে গিয়ে বানিয়ে বানিয়ে ডাক্তার এই বলেছেন,ডাক্তার ওই বলেছেন - বলতে বলতে নিজেও ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। প্রতিদিন দু থেকে তিনবার বীরেনবাবুর ফ্ল্যাটে নন্দিনীকে যেতেই হয়।
যেহেতু শ্বাশুড়ী আছেন এবং তিনি বীরেনবাবুদের অবস্থা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল তাই সব সময়ই তিনি তার বৌমার এই কাজকে সমর্থন করে গেছেন।
আগেরদিন অনেক রাত পর্যন্ত বীরেনবাবুর শরীর খারাপ হওয়াতে নন্দিনী ওদের ফ্ল্যাটেই ছিল।তার আগেই সন্ধ্যার দিকে ললিতাদেবীকে নিয়ে নার্সিংহোম ভর্তি করতে হয়েছে প্রচণ্ড শরীর খারাপ হওয়াতে।বীরেনবাবু চোখে খুবই কম দেখেন। মোটা পাওয়ারের চশমা পরেও সবকিছু আবছা দেখেন।চোখে ভালো দেখতে পেলে তিনি দেখতে পেতেন কিংবা জানতে পারতেন এক একটা গয়না বিক্রির টাকায় এক একটা কেমো নেওয়ার ফলে তার লালির মাথায় এখন একটাও চুল নেই।
সেদিন যখন নন্দিনী বীরেনবাবু অসুস্থ্য হলে বাড়িতে ডাক্তার দেখে এনেছিল তখন ডাক্তারবাবুর সাথে কথা প্রসঙ্গে বলছিলো, মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে ভদ্রলোককে এতদিন ঠিক রেখেছিলাম।কিন্তু তার চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হলেও কানটা তো ঠিক আছে।মাসিমাকে নিয়ে যাওয়ার সময় পাশের ফ্ল্যাটের দু'জন ভদ্রলোকের কানাঘুষো শুনে উনি জেনে যান মাসিমার রোগের কথা।তারপর থেকেই এই অবস্থা।
বীরেনবাবু রাতে দরজা বন্ধ না করে শোয়ার ফলে সকালে দুধ দিতে এসে ছেলেটি ঘরে উঁকি দিয়ে দেখে বীরেনবাবু মেঝেতে পড়ে আছেন।চিৎকার করে লোক জড়ো করে।সেই সময় নিচুতে একটি ট্যাক্সি তার চালক পরিষ্কার করছিলো।সেও ছুটে আসে।
রাত করে ফেরার ফলে ঘুম থেকে উঠতে নন্দিতার একটু দেরি হয়।কিন্তু ওই ট্যাক্সি আর সিঁড়িতে অসংখ্য পায়ের শব্দ শুনে তৎক্ষণাৎ দৌড়ে চলে যায় সেখানে।গিয়ে দেখে সব শেষ।বীরেনবাবু আর নেই।ততক্ষনে ফ্ল্যাটের অপর এক বাসিন্দা যিনি পেশায় ডাক্তার তিনি জানিয়ে দেন বেশ কয়েক ঘণ্টা আগেই তিনি এ নশ্বর দেহ ত্যাগ করেছেন।
বীরেনবাবুর ফ্ল্যাটে যাওয়ার আগে নন্দিনী ফোনটা নিয়েই গেছিলো কিছুটা বিপদের আঁচ পেয়ে।ঠিক তখনই নার্সিংহোম থেকে ফোন করে নন্দিনীকে জানিয়ে দেওয়া হয় ভোর চারটে নাগাদ ললিতাদেবী পরপারের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছেন।
ফ্ল্যাটের লোকেরা তার ছেলেকে জানানোর ফলে সে জানিয়ে দেয় তার পক্ষে আসা কিছুতেই সম্ভব নয় এখন। দুটি দেহ চাঁদা তুলে সৎকার করা হয়।