Friday, September 2, 2022

কেউ কারো নয়

কেউ কারো নয় 

কতদিন আর মিথ্যে আশ্বাস দিয়ে যাবো --

  ব্যালকনি থেকে নন্দিতা উঁকি দিয়ে দেখে গেটের কাছে একটি হলুদ ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে।ফ্ল্যাটটিতে আটটা পরিবার বাস করে।একমাত্র বীরেনবাবুর ছাড়া আর সকলেরই গাড়ি রয়েছে। বীরেনবাবু আর তার স্ত্রী থাকেন দোতলার পশ্চিম দিকের ফ্ল্যাটটিতে।
  বীরেনবাবু আর তার স্ত্রীর দু'জনেরই বয়স হয়েছে।ছেলে থাকে আমেরিকায়।বছর দু'য়েক আগে এসে বাপের বিশাল তিনতলা বাড়ি বিক্রি করে বাবা,মায়ের জন্য ছোট্ট দু'কামরার এই ফ্ল্যাটটি কিনে দিয়ে বাকি টাকা পয়সা নিয়ে পুনরায় আমেরিকা চলে গেছেন।যদিও স্বামী,স্ত্রী দেখা হলে প্রায়ই বলে থাকেন ছেলে মাসে মাসে টাকা পাঠায় কিন্তু সেটা যে সত্যি নয় এটা ফ্ল্যাটের অনেকেই বুঝতে পারেন।
  মাঝে মাঝে নন্দিতা এটা সেটা রান্না করে যখন তাঁদেরকে দিতে গেছে অধিকাংশ দিনই সে দেখেছে এক তরকারী ভাত করা।প্রথম থেকেই নন্দিতার বয়স্ক এই মানুষ দু'টির প্রতি অদ্ভুত এক মায়া।কেন তা সে নিজেই জানে না।নন্দিতা তার শ্বাশুড়ী ,চার বছরের ছেলে আর স্বামী থাকে তিন তলায়।
  বীরেনবাবুর স্ত্রীর হঠাৎ এই বয়সে এসে ধরা পড়ে ব্লাড ক্যান্সার।যেহেতু নন্দিনী বীরেনবাবুর স্ত্রী ললিতাদেবীকে নিয়ে নিজে ডাক্তারের কাছে গিয়েছিল তাই ললিতাদেবী নন্দিনীকে বলেছিলেন,
--- এই বয়সে এসে মানুষটা একথা জানলে বড্ড কষ্ট পাবেন। তাই মা তুমি এই রোগের কথা ওনাকে কিছু জানিও না।কটাদিনই বা আর বাঁচবেন আর আমারও তো সময় শেষ।
 নন্দিনী ললিতাদেবীর কথা রেখেছে। সে শুধু বীরেনবাবু কেন ফ্ল্যাটের অন্যান্য বাসিন্দাদেরও অনেকদিন পর্যন্ত কিছু বলেনি।নার্সিংহোমে নিয়ে যাওয়া, ওষুধপত্র কেনা সবই নন্দিনী করে। নন্দিনী বয়স্ক ভদ্রলোকটিকে নিজের বিবেকের বিরুদ্ধে গিয়ে বানিয়ে বানিয়ে ডাক্তার এই বলেছেন,ডাক্তার ওই বলেছেন - বলতে বলতে নিজেও ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। প্রতিদিন দু থেকে তিনবার বীরেনবাবুর ফ্ল্যাটে নন্দিনীকে যেতেই হয়। 
  যেহেতু শ্বাশুড়ী আছেন এবং তিনি বীরেনবাবুদের অবস্থা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল তাই সব সময়ই তিনি তার বৌমার এই কাজকে সমর্থন করে গেছেন।
  আগেরদিন অনেক রাত পর্যন্ত বীরেনবাবুর শরীর খারাপ হওয়াতে নন্দিনী ওদের ফ্ল্যাটেই ছিল।তার আগেই সন্ধ্যার দিকে ললিতাদেবীকে নিয়ে নার্সিংহোম ভর্তি করতে হয়েছে প্রচণ্ড শরীর খারাপ হওয়াতে।বীরেনবাবু চোখে খুবই কম দেখেন। মোটা পাওয়ারের চশমা পরেও সবকিছু আবছা দেখেন।চোখে ভালো দেখতে পেলে তিনি দেখতে পেতেন কিংবা জানতে পারতেন এক একটা গয়না বিক্রির টাকায় এক একটা কেমো নেওয়ার ফলে তার লালির মাথায় এখন একটাও চুল নেই।
  সেদিন যখন নন্দিনী বীরেনবাবু অসুস্থ্য হলে বাড়িতে ডাক্তার দেখে এনেছিল তখন ডাক্তারবাবুর সাথে কথা প্রসঙ্গে বলছিলো, মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে ভদ্রলোককে এতদিন ঠিক রেখেছিলাম।কিন্তু তার চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হলেও কানটা তো ঠিক আছে।মাসিমাকে নিয়ে যাওয়ার সময় পাশের ফ্ল্যাটের দু'জন ভদ্রলোকের কানাঘুষো শুনে উনি জেনে যান মাসিমার রোগের কথা।তারপর থেকেই এই অবস্থা।
  বীরেনবাবু রাতে দরজা বন্ধ না করে শোয়ার ফলে সকালে দুধ দিতে এসে ছেলেটি ঘরে উঁকি দিয়ে দেখে বীরেনবাবু মেঝেতে পড়ে আছেন।চিৎকার করে লোক জড়ো করে।সেই সময় নিচুতে একটি ট্যাক্সি তার চালক পরিষ্কার করছিলো।সেও ছুটে আসে।
 রাত করে ফেরার ফলে ঘুম থেকে উঠতে নন্দিতার একটু দেরি হয়।কিন্তু ওই ট্যাক্সি আর সিঁড়িতে অসংখ্য পায়ের শব্দ শুনে তৎক্ষণাৎ দৌড়ে চলে যায় সেখানে।গিয়ে দেখে সব শেষ।বীরেনবাবু আর নেই।ততক্ষনে ফ্ল্যাটের অপর এক বাসিন্দা যিনি পেশায় ডাক্তার তিনি জানিয়ে দেন বেশ কয়েক ঘণ্টা আগেই তিনি এ নশ্বর দেহ ত্যাগ করেছেন।
  বীরেনবাবুর ফ্ল্যাটে যাওয়ার আগে নন্দিনী ফোনটা নিয়েই গেছিলো কিছুটা বিপদের আঁচ পেয়ে।ঠিক তখনই নার্সিংহোম থেকে ফোন করে নন্দিনীকে জানিয়ে দেওয়া হয় ভোর চারটে নাগাদ ললিতাদেবী পরপারের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছেন।
  ফ্ল্যাটের লোকেরা তার ছেলেকে জানানোর ফলে সে জানিয়ে দেয় তার পক্ষে আসা কিছুতেই সম্ভব নয় এখন। দুটি দেহ চাঁদা তুলে সৎকার করা হয়।


  
    

অতীত শুধু ভাবনায় মানায়

জীবনে দেখা স্বপ্নগুলো কোনটাই পূরণ হল না নন্দিনীর। নিজেকে নিয়ে যখন ভাবতে বসে তখন বুকটা কেমন ফাঁকা হয়ে যায়। অথচ পড়াশুনায় বেশ ভালই ছিল সে,চেহারাও খারাপ ছিল না।কিন্তু ভাগ্য! সবকিছু থাকা স্বর্তেও ভাগ্যের বিরম্বরায় জীবন যুদ্ধে পর্যুদস্ত সে। কিশোরী বয়সে ভালোলাগার কথা সেই মানুষটাকেই কোনদিন মুখ ফুটে বলতে পারেনি। বাবার পছন্দ করা ছেলেকে পড়াশুনার মাঝপথে বিয়ে দেওয়ার ফলে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর স্বপ্নটুকুও ধুলিৎসাত হয়ে যায়।
 দুই সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে বেঁচে থাকার তীব্র লড়াইয়ে যখন নিজের মনকে শক্ত করে নিয়েছে ঠিক সেই সময়ে হঠাৎ করেই বিমলের চলে যাওয়া। লড়াইয়ের রাস্তাটা তখন আরো বন্ধুর হয়ে পড়ে। লড়াইটা তখন নন্দিনীর একার কাছে আরো কঠোর হয়ে ওঠে।মেয়ের শিক্ষা সম্পন্ন করার পর তার বিয়ে দিয়ে ছেলের উচ্চশিক্ষার আর্থিক দিক থেকে যখন জর্জরিত ঠিক তখনই ফেসবুকের সূত্র ধরে তার জীবনে নূতন করে ঝড় তোলে কিশোরীবেলার সেই ভালোলাগা। 
 পুরনো অনেক কথার ভিড়ে ফোনালাপেই মনের অনেক কাছে চলে আসে তারা। কোন চাহিদা ছাড়াই নন্দিনী বাঁচার একটা রাস্তা খুঁজে পায়। কিন্তু সে ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেনি যে কিশোরকে তার ভালো লেগেছিলো জীবনের শুরুতে, তার এখন আমূল পরিবর্তন! 
  নন্দিনী যে তার জীবনে শুধুমাত্র একটা সময় কাটানোর যন্ত্র সৌমেনের কথাবার্তায় সে কোনদিনও বুঝতে পারেনি।বেশ কয়েকমাস কেমন একটা নেশার মত পেয়ে বসেছিলো নন্দিনীর। সৌমেন যেহেতু নির্দিষ্ট সময় ধরে ফোন করতো তাই ওই সময়টা নন্দিনী সব কাজ শেষ করে ফোনের অপেক্ষাতেই থাকতো। সৌমেনের সাথে কথা বলতেই ভালো লাগতো নন্দিনীর। নন্দিনী জানতো সৌমেন বিবাহিত,স্ত্রী ও দুই সন্তানকে নিয়ে সে খুব সুখী। সুতরাং নন্দিনীর অন্য কোন চাহিদা সৌমেনের কাজ থেকে ছিল না; শুধু মাঝে মধ্যে হাজার হাজার মাইল দূর থেকে একটু কথা বলা। এই কথা বলার মধ্যেই নন্দিনী ফিরে পেয়েছিল তার হারানো শৈশব।
 কিন্তু হঠাৎ করেই সৌমেন নিজেকে গুটিয়ে নিতে শুরু করে।সৌমেনের কথাবার্তায় নন্দিনী বহুবার বুঝতে পেরেছে সে যতটা সুখী হওয়ার ভান করে ততটা সুখী সে নয়, সেও বোধহয় এইভাবে হঠাৎ পুরনো স্মৃতি রোমন্থন করে ভালো থাকে।কিন্তু বউকে যে মারাত্মক ভয় পায় আর হয়ত এই ভয় পাওয়ার কারণ থেকেই কোনকিছু ঘটায় সে নন্দিনীকে ফোন করা মোটামুটি বন্ধই করে দেয়। 
 হঠাৎ করে এই বয়সে এসে বিনা কারণে এত বড় একটা আঘাত নন্দিনী কিছুতেই নন্দিনী মেনে নিতে পারে না।তার আত্মসম্মানে প্রচণ্ড আঘাত লাগে। কারণ সৌমেনের কাছ থেকে তার কিছুই চাওয়ার ছিল না। সৌমেন সরাসরি যদি তাকে কারণটা জানিয়ে সরে যেত তাহলে নন্দিনীর এতটা খারাপ লাগতো না।কারণ সেও চায় না তার কারণে সৌমেনের সংসারে কোন ক্ষতি হয়। এক্ষেত্রে নন্দিনীর মনে হতে লাগলো "অপরাধী জানিল না কি তার অপরাধ বিচার হইয়া গেলো" -। 
 নিঃসঙ্গ জীবনে সৌমেন দমকা হাওয়ার মত বেশ কিছুদিন নন্দিনীর জীবনে ফ্রেস অক্সিজেন হয়ে এসেছিলো। নন্দিনী সৌমেনের না বলা সত্ত্বেও তার অসুবিধাগুলো বুঝতে পেরেই তাকে ব্লক করে দেয়। জীবন যুদ্ধে আরো একবার পরাজয় নন্দিনীর!
 তবে এই ঘটনা থেকে নন্দিনী একটা কথা বুঝতে পারে আর তা হল অতীত অতীতেই থাকা ভালো ,সুযোগ পেলেও তাকে কখনোই সামনে আনা উচিত নয়। তাতে কষ্ট বাড়ে বৈ কমে না।অতীত থাক মননে আর ভাবনায়। শুধুমাত্র অবসরে একান্তে তাকে ভাবলে অন্তত মানসিক কিছুটা তো তৃপ্তি আসবে। সুযোগ পেলেও অতীতকে গ্রহণ না করায় ভালো।