Monday, May 19, 2025

ভালোবাসার বন্ধন (১ম পর্ব)

ভালোবাসার বন্ধন (১ম পর্ব)
  মেয়ের বয়স সবে আঠারো পেরিয়েছে। গরীবের ঘরের সন্তান তাই মা,বাবা অনেক চেষ্টা করে গ্রামের এক অবস্থাপন্ন ঘরের কলেজ পড়ুয়া ছেলেকে পাত্র হিসেবে নির্বাচন করেছেন। মেয়ে নলিনীর কান্নাকাটি, হাতেপায়ে ধরা কোন আপত্তিই ধোপে টেকেনি। সামান্য কয়েকজন বরযাত্রী নিয়ে বাইশ বছরের ছেলেটি মাথা নত করে বিয়ে করতে আসে। কারণ এই বিয়েতে তারও কোন মত নেই। সবে দ্বিতীয়বর্ষ তার। স্বপ্ন তার আকাশ ছোঁয়া। কিন্তু অবস্থার পরিপেক্ষিতে তারও বিয়েতে রাজি হওয়া। 
  বিয়ের আসরে বর কনে দু'জনেই গম্ভীর। দু'জনেরই মুখ নীচের দিকে। শুভ দৃষ্টিতেও কেউ কারো মুখ দেখলো বলে মনে হল না। কিন্তু বিয়ে হয়ে গেলো। মেয়েও পরদিন শ্বশুরবাড়ি চলে গেলো।
  ফুলশয্যার রাতে তপেশ ঘরে ঢুকে প্রথমেই টিউবলাইট বন্ধ করে দিয়ে বেড সুইচটা জ্বালিয়ে দিয়ে নলিনীর দিকে পিছন ফিরে খাটের উপর পা ঝুলিয়ে দিয়ে বসে বলতে শুরু করলো,
-- শুভ দৃষ্টিতে আমি তোমার মুখ দেখিনি। সেই কারণে হয়ত তুমি ভাবতে পারো আমি অন্য মেয়ের প্রতি আসক্ত। কিন্তু তা নয়। আমি এ বিয়ে করতে চাইনি। আমার ঠাকুমা নাতবৌ দেখার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছেন। তার শরীর ভালো নয়। সেটা তুমি নিজেই দেখেছো। বাবার একান্ত অনুরোধে আমার এই বিয়ে করা। আমি এখানে থাকিও না সেটা তুমি নিশ্চয় শুনেছ। তুমি এখানে অনায়াসেই থাকতে পারো সেক্ষেত্রে আমি তোমায় কিছু বলবো না। কিন্তু স্বামী হিসাবে আমি নিজের পায়ে না দাঁড়ানো পর্যন্ত কোন দায়িত্ব যেমন পালন করতে পারবো না ঠিক তেমনই তোমার উপর কোন অধিকার প্রয়োগও করবো না। দু একদিনের মধ্যেই আমি চলে যাবো কলকাতায় যেখানে থাকি। তোমার বাড়ির অবস্থা সম্পর্কে আমি সব জানি। আমার ঠাকুমা তোমায় যে গয়নার বাক্স দিয়েছেন তাতে বেশ কয়েক ভরি গয়না আছে। ইচ্ছা করলে ওই গয়না বিক্রি করে তুমি তোমার জীবনটাকেও নিজের মত করে গড়ে নিতে পারো। ইচ্ছে হলে এখানে থাকতে পারো আবার বাপের বাড়িতেও চলে যেতে পারো। 
 -- তাহলে বিয়েতে রাজি হলেন কেন?
-- ওই যে বললাম বাবার কথাতে। হ্যাঁ বলতেই পারো তোমার জীবনটা নষ্ট করলাম কেন? কিন্তু আমার মনেহয় তোমার জীবনটা এবার তুমি গুছিয়ে নিতে পারবে। পড়াশুনাটা আবার শুরু করো নিজের পায়ে দাঁড়াও। আমিও নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাই। বাপ, ঠাকুর্দার টাকায় সারাজীবন বসে খেতে আমি চাই না। ইচ্ছে হলে আমার জন্য অপেক্ষা করতে পারো নতুবা নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে নিজের পছন্দ মত কাউকে জীবন সঙ্গী করতেই পারো। ততদিনে এই পরিবারে অনেক পরিবর্তন হয়ে যাবে। তোমাকে কেউ কোন বাধা দেবেন না। বাবা পুরো বিষয়টাই জানেন।
যাক গে আমার যা বলার ছিল বলা হয়ে গেছে। অনেক রাত হল এবার শুয়ে পড়ো। আজ না হলেও একদিন ঠিক বুঝবে আমি উভয়ের ভালোর জন্যই এ পথ বেছে নিয়েছি।
 নলিনী কোন কথা আর না বলে খাট থেকে নেমে এদিকওদিক কী যেন খুঁজতে থাকে। দেখতে পেয়ে তপেশ বললো,
-- তুমি খাটেই শোও। পাশেই আর একটি ঘর আছে আমি ওখানেই শুয়ে পড়বো। কোন অসুবিধা হবে না।
 নলিনী পুণরায় খাটে উঠে যায়। সেও যেন তপেশের সিদ্ধান্ত জেনে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। কারণ পড়াশুনাটা ছাড়তে সেও কখনো চায়নি এমন কী বিয়েও বসতে চায়নি। কিন্তু বাবার আর্থিক স্বচ্ছলতা না থাকায় উচ্চমাধ্যমিক দিয়েই পড়াশুনায় ইতি টেনেছিল।
 পরদিন তপেশ বেরিয়ে যাওয়ার সময় তার বাবা তন্ময়বাবু তাকে বললেন,
-- অষ্টমঙ্গলা সেরে গেলে হত না? 
-- তোমার সাথে কথা ছিল আমি বিয়ে করবো ঠাকুমাকে নাতবৌ দেখাতে। আমি সে কথা রেখেছি। বৌভাত মিটে গেছে। বাকি আর কোন আমার দায়িত্ব নেই। তবে নিরপরাধ অসহায় মেয়েটির কথা ভেবে একটা অনুরোধ তোমায় করবো। সংসার যাঁতাকলে মেয়েটিকে না বেঁধে রেখে ওকে পড়াশুনাটা চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ দিও।
-- ওকে নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। ওর দায়িত্ব আজ থেকে আমার। দেখো পরে যেন তোমাকে আফসোস করতে না হয়। 
 আড়াল থেকে নলিনী সব শুনলো। বলা ভালো শ্বশুরের কথা শুনে কিছুটা নিশ্চিতও হল। তপেশ বেরিয়ে গেলো।
 ছেলেবেলাতেই তপেশ তার মাকে হারিয়েছে। ঠাকুমার কাছেই সে মানুষ। মা ছিলেন তাদের পরিবারের একমাত্র সন্তান। দাদু,ঠাকুমা অনেক আগেই মারা গিয়েছেন। আত্মীয়স্বজন বলতে সেরূপ কেউই নেই। বিয়ের কয়েক মাসের মধ্যেই ঠাকুমাও চলে গেলেন। মৃত্যুর সময় কিংবা মৃত্যুর পর তাকে খবর দেওয়া হলেও তপেশ আসেনি বরং বলা ভালো তার পরীক্ষা চলছিল তাই ইচ্ছা থাকলেও সে আসতে পারেনি। কিন্তু শ্রাদ্ধের দিন সে উপস্থিত হয়। অদ্ভুত ব্যাপার হল পুরো বাড়ির কোথাও সে নলিনীকে দেখতে পায় না। নলিনীকে দেখার জন্য সে যে খুব একটা ব্যাকুল হয়েছিল তা মোটেই নয় কিন্তু কোথাও যেন একটা ইচ্ছা মনের মধ্যে কাজ করছিল। তার বাবা কিংবা বাড়ির কাজের লোকদের কাছে জানতে চাওয়ার সাহস হয়নি। 
 তপেশের বাবা এমনিতেই একটু গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ।
এবার বাড়িতে এসে তপেশ দেখে বাবা যেন শোকে, কষ্টে আরও গম্ভীর হয়ে গেছেন। সব কথার উত্তর মাথা নাড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টাই করেন। শ্রাদ্ধের কাজের জন্য যারা বাড়িতে আজ এসেছেন তারা তাদের নিজেদের মনেই কাজ করছেন কেউ যে বাবার কাছে এসে কিছু জিজ্ঞাসা করছে তা মোটেই নয়। কিন্তু কাজকর্ম সুষ্ঠুভাবেই চলছে। মনেহচ্ছে অলক্ষ্যে কেউ যেন কাজ করিয়ে নিচ্ছে। তপেশ নিজেকে এ বাড়িতে আজ অবাঞ্ছিত মনে করছে। কেউই সেভাবে তার সাথে কথাও বলছে না। বাবার কাজ শেষ হওয়ার পর ডাক পড়লো তপেশের। তখন তাপসবাবু ভিতরের ঘরে চলে গেলেন। এতটাই ধীরপায়ে হেঁটে গেলেন খড়ম পরে সিমেন্টে বিন্দুমাত্র আওয়াজ হল না। অনাহুতের মত তপেশ তার ঠাকুমার কাজ সেরে উঠলো। সামনে তাকিয়ে দেখে বাবা পুনরায় এসে দাঁড়িয়েছেন। পাশে দাঁড়ানো তার বিয়ে করা বউ নলিনী। মাথায় অনেকটাই ঘোমটা টানা মুখটা দেখা যাচ্ছে না। বাবা ইশারায় তপেশকে সরে যেতে বললেন। তপেশ সরে দাঁড়ালে নলিনী গিয়ে সেই আসনে বসে ঠাকুরমশাইয়ের কথামত কাজ করতে লাগলো। তপেশ সেখান থেকে উঠে নিজের ঘরে চলে যায়। বুঝতে পারে এ বাড়িতে এখন নলিনীই সব। তার প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়েছে। 
 গ্রামে দরিদ্র শ্রেণীর বাস বেশি। তাপসবাবু পুরো গ্রামবাসীদের নিমন্ত্রণ করে খাইয়েছেন এবং বস্ত্র বিতরণ করেছেন নলিনীর হাত দিয়েই। দূরে দাঁড়িয়ে থেকে তপেশ শুধু এগুলো দেখেছে। সে ঘরেই ছিল খেতেও যায়নি। দুপুর গড়িয়ে গেলেও সে যখন খেতে নামেনি নিজের ব্যাগ গুছাতে ব্যস্ত সেই সময় একজন পরিচালিকা এসে তার ঘরে খাবার রেখে খেয়ে যেতে বলে বেরিয়ে যায়। সে না খেয়েই ব্যাগ নিয়ে বেরোতে গিয়ে দেখে দরজার কাছে তার বাবা দাঁড়িয়ে। তিনি বলেন,
-- তুমি বংশের একমাত্র ছেলে। আমার মায়ের কাজে খালি মুখে বেরিয়ে গেলে মায়ের আত্মা শান্তি পাবে না। খেয়ে তবে যাও।
 কোন উত্তর না দিয়ে তপেশ ঘরে ঢুকে দুটি মুখে দিয়ে ব্যাগ নিয়ে বাবার ঘরে ঢুকে দেখে নলিনী বাবাকে ওষুধ খাওয়াচ্ছে। বয়সের কারণে এখন অনেক ওষুধই তাপসবাবুকে খেতে হয়। সেই একইভাবে নলিনীর ঘোমটা টানা। মুখ দেখার উপায় নেই। বাবাকে প্রণাম করতে গেলে তিনি বলেন,
-- আমার আশীর্বাদ তোমার মাথার উপর সব সময় আছে। আজকে মায়ের কাজের দিনে আর পা ছুঁয়ে প্রণাম কোরো না।
 -- আমি আসছি।
 তপেশ বেরিয়ে যায়। কেউ আর কোন কথা বলে না।গেটের বাইরে গিয়ে সামনে ফিরে গেট লাগাতে গিয়ে উপরের দিকে তাকিয়ে দেখে ব্যালকনিতে নলিনী দাঁড়িয়ে। কিছুটা সময় সেও তাকিয়ে থাকে। কিন্তু পরিষ্কার করে কেউ কিছুই দেখতে পায় না। 
  বিয়ে একটা পবিত্র বন্ধন। আগেকার দিনে বিয়ের পরেই অপরিচিত দু'টি মানুষ একে অপরকে  ভালবাসতে শুরু করতো। এ বন্ধন কি এত সহজে এড়ানো যায়? কোথাও কি দু'জনের মনে ভালোবাসার কোন রেখা পড়েনি?

ক্রমশ -