Sunday, November 19, 2023

স্বপ্ন দেখা বারণ

 স্বপ্ন দেখা বারণ 

 কবরীর সামনে খামটা এগিয়ে দেওয়ার সাথে সাথেই সে বুঝতে পারে কে তাকে এটা পাঠিয়েছে। কিন্তু সে তো কোনদিন কারো কাছেই কিছু সাহায্য চায়নি। বরং কেউ তাকে অর্থ সাহায্য করতে চাইলে সে নিজেই সামলে নিতে পারবে বলে জানিয়েছে। এই অর্থ সাহায্যর ব্যাপারটা অবশ্য বেশ কয়েক বছর আগে একমাত্র আয়ান তাকে বলেছিলো। তখন থেকেই কবরীর মা শয্যাশায়ী। বাম অঙ্গ পড়ে গিয়ে সেই থেকেই অসার। সামান্য একটা চাকরি গ্রাম পঞ্চায়েত অফিসে। মাস গেলে মাত্র কয়েক হাজার টাকা হাতে আসে। তাই দিয়েই দিন গুজরান আর মায়ের চিকিৎসা। আয়ান গ্রামেরই ছেলে। পরোপকারী, মানুষের বিপদ দেখলেই আপন পর না ভেবে ঝাঁপিয়ে পড়ে। কবরী বুঝতে পারে আয়ান তাকে ভালোবাসে। কিন্তু গ্রামের লোকেরা এই ভালোবাসায় বাধা হয়ে দাঁড়াবে সেটা আয়ান এবং কবরী দু'জনেই ভালোভাবে জানে। কারণ কবরীরা হিন্দু আর আয়ানরা মুসলিম। তাই দু'জনেই কেউ কাউকেই জানতে না দিয়ে তাদের ভালোবাসা নিজেদের অন্তরেই রেখে দেয়।
  আয়ান চাকরি পেয়ে শহরে চলে আসে। আসবার আগে কবরীর সাথে দেখা করে বলে,
-- গ্রাম ছেড়ে চলে যাচ্ছি ঠিকই কিন্তু কোন প্রয়োজন পড়লে আমায় জানাতে ভুলো না। ফোন নম্বরটা রাখো।
-- সামান্য হলেও যা হোক একটা চাকরি করি। দু'টো মাত্র প্রাণী ঠিক চালিয়ে নিতে পারবো। তুমি ভালো থেকো। 
 কিন্তু দু'বছরের মধ্যে আয়ান আর গ্রামে ফেরেনি। কোনদিন আর ফোনও করেনি। প্রথম প্রথম কবরীর খারাপ লাগলেও এখন আর খারাপ লাগে না। কিন্তু মাঝে মধ্যেই আয়ানের কথা তার মনেপড়ে। ভুলতে চাইলেই কি আর সবকিছু মানুষ ভুলে যেতে পারে? 
  আয়ানদের বাড়ি কবরী কোনদিন যায়নি। শুনেছিল ওদের বাড়ি নাকি সর্দার পাড়ায়। ইচ্ছে করলেই কারো কাছে জেনে সে আয়ানের খবর নিতে পারতো। কিন্তু কখনোই চেষ্টা করেনি। একটা যুবতী মেয়ে গ্রামগঞ্জে যখনই একজন যুবকের খবর নেবে তখনই নানান গুঞ্জন উঠবে। হয়ত তখন শালিসী সভা ডেকে বিচার করার নামে চাকরিটাও নড়বড়ে করে দেবে। তাই মন চাইলেও বিবেক সায় দেয়নি।
  আর এদিকে আয়ান শহরে আসার পথেই তার মোবাইল হারিয়ে ফেলে। বুক পকেটে মোবাইল থাকায় স্টেশনে ভিড়ের মধ্যে হয় তা পড়ে যায় নতুবা কেউ তুলে নেয় পকেট থেকে। শহরে পৌঁছানোর পনের দিনের মাথায় বাড়ির লোক সেখানে পৌঁছে যায়। দূর সম্পর্কের চাচার বাসায় থাকা আগে থাকতেই ঠিক ছিল। তাই তাদের সেখানে পৌঁছাতে কোন বেগ পেতে হয়নি। দুই বাড়ির লোকেরা আগে থাকতেই ঠিক করে রেখেছিলেন আয়ানের চাচাত বোনের সাথে তার বিবাহ। আয়ানের কোন আপত্তিই ধোপে টেকে না। সে বিয়ে করতে বাধ্য হয়। বাড়ির লোকের লাভ একমাত্র মেয়ে হওয়ার সুবাদে শহরে দোতলাবাড়ি।
 কিন্তু সে ওখানে থেকেই খবর রাখে কবরীর। দু'বছর বাদে আয়ান গ্রামে ফেরে বউ নিয়ে। খবর যায় কবরীর কাছে। হঠাৎ করেই বুকটা একটু যেন কেপে ওঠে। হয়ে যায় একটু আনমনা। কিন্তু অচিরেই নিজেকে সামলে নেয়। 
  সে সময় মায়ের প্রচণ্ড বাড়াবাড়ি হওয়াতে গ্রামীণ হাসপাতাল জানিয়ে দেয় তাদের হাতের বাইরে। শহরে নিয়ে যেতে হবে। অর্থবল,বাহুবল কোনোটাই নেই। হঠাৎ অপরিচিত বয়স্ক এক ভদ্রলোক সন্ধ্যায় বাড়িতে আসে কিছু টাকা নিয়ে। টাকাটা যদিও খামের মধ্যে ছিল কিন্তু প্রেরকের নাম না থাকলেও কবরীর বুঝতে অসুবিধা হয় না এটা আয়ানই পাঠিয়েছে। হাত জোড় করে খামটা নিতে অস্বীকার করে। 
 পরদিন সকালে মায়ের সামান্য গয়না নিয়ে বিক্রি করতে যখন সোনার দোকানে যায় তখন পথে আয়ানের সাথে দেখা। আয়ানই প্রথম জানতে চায়,
--- কেমন আছো?
-- বিয়ে করেছ শুনলাম। বউ দেখাবে না?
-- বিয়ে করেছি না, করতে বাধ্য হয়েছি। আমার বউ তোমার মত অত সুন্দরী নয়।
--- যাক অন্যভাবে হলেও সৌন্দর্য্যের টারিফ তো করলে। এমন কী হল হঠাৎ চাকরি পেয়েই যোগাযোগ বন্ধ করে দিলে? 
-- জীবনে এমন অনেক ঘটনা ঘটে যারজন্য মানুষ মোটেই প্রস্তুত থাকে না। ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে পরিবারের গুরুজনের কথা মেনে নিতে বাধ্য হতে হয়। হিসাব করে জীবন চলে না। 
 চুপ করে থাকে কবরী। আয়ান বলতে থাকে,
 এজীবনে সবকিছু ওলটপালট হয়ে গেলো শুধু জাত কিংবা ধর্মের জন্য। কত জীবন নষ্ট হয়ে যায় এই জাত আর ধর্মের বিচারে। কবে যে আমাদের বাঙ্গালী সমাজ এর থেকে পরিত্রাণ পাবে তা বোধকরি স্বয়ং সেই সৃষ্টিকর্তাও জানেন না। 
 আয়ান চুপ করে যায়। কবরী তার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে দেখতে পেয়ে আবারও শুরু করে,
-- জানি কোন লাভ নেই আগেও ছিলো না তবুও আজ বলি কবরী, আমি তোমায় ভালবাসতাম আজও বাসি যতদিন এ দেহে প্রাণ আছে ততদিন ভালোবেসে যাবো। পরের জন্মে আমরা যেন একই ধর্মের মানুষ হয়ে পৃথিবীতে আসি। এই জাতপাতের বালাই এই বাঙ্গালী সমাজ থেকে কোনদিনও বিলুপ্ত হবার নয়।
 আয়ান চুপ করে যায়। চারিদিকে একটু একটু করে অন্ধকার নেমে আসছে। কবরী অন্ধকারের মধ্যেই শাড়ীর আঁচল দিয়ে চোখটা মুছে ধীরপায়ে হাঁটতে শুরু করে। কোন উত্তর সে আয়ানের কথার দেয় না। আয়ান সেদিকে তাকিয়ে থাকে। আস্তে আস্তে অন্ধকারের ভিতর কবরী একসময় আয়ানের চোখের আড়াল হয়ে যায় ঠিক যেভাবে আয়ানের জীবন থেকে সে হারিয়ে গেছে।

#মানবী ২০-১১-২৩