বাবার চিকিৎসা করাতে এসে যার সাথেই কথা হয় সে যেকোন একটি কাজ তার বড় প্রয়োজন সেটা বলতে ভোলে না। আর এভাবেই সে ডাক্তার স্বরূপ দাশগুপ্তের কাছেও কথাটা বলে।
ডক্টর স্বরূপ বেশ কিছুক্ষণ সুবর্ণার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। ড্রয়ার খুলে একটা কার্ড বের করে তার হাতে দিয়ে জানতে চাইলেন
-- কতদূর পড়াশুনা করেছো? যদিও যে কাজটার কথা আমি ভাবছি সেটার জন্য শিক্ষাগত যোগ্যতার কোন দরকার নেই। তোমার বাবার টিবি রোগের চিকিৎসা আজ লাস্ট ডোজ। তুমি আগামী রবিবার সকালের দিকে চলে এসো। তবে একটা কথা একটু জেনে নিই মা।অসুস্থ্য একজনকে দেখভাল করতে হবে। সপ্তাহে রবিবার ছুটি পাবে। রাতেও থাকতে হবে তার কাছে। মাইনে খারাপ পাবে না। রাজি থাকলে রবিবার চলে এসো।
-- আমি রাজি। সম্মান বাঁচিয়ে যে কোন একটা কাজ পেলেই আমার চলবে
-- বাবাকে নিয়ে এখন আর কোন চিন্তা করতে হবে না। শুধু খাওয়াদাওয়া ভালো চলবে।
বাবাকে নিয়ে বাড়িতে ফেরার পথে সব জানায় সে তার বাবাকে। তিনি একটি দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে বলেন,
-- এত লেখাপড়া শিখে শেষ পর্যন্ত আয়ার কাজ
-- ভাবছো কেন বাবা কলকাতা শহরে থাকতে পারলে ভালো কাজের সন্ধান ঠিক পেয়ে যাবো। এখন এই মুহূর্তে এই ছাড়া আর কোন উপায় নেই আমাদের।
-- আরও বেশি করে কিছু টিউশনি তো করতে পারতিস।
-- করছিলাম তো বাবা।কিন্তু ক'টা টাকা আসে তাতে? দেখি ওই কাজ করতে করতেই ভালো কোন কাজ খুঁজে নেবো আমি। তুমি চিন্তা কোরো না। দেখো সব ঠিক হয়ে যাবে।
দু'দিন পরে সুবর্ণা একটা বিগ সপারে নিজের প্রয়োজনীয় কিছু জিনিসপত্র নিয়ে স্বরূপবাবুর বাড়ি এসে হাজির হয়। ডাক্তার স্বরূপের বিশাল বাড়ি। গেটে সেন্ট্রি। গেট পেরিয়ে বাড়িতে ঢুকতে গেলে মিনিট দু'য়েক হাঁটতে হবে। দু'পাশে নানান জাতের দেশী,বিদেশি গোলাপ ফুটে আছে। একজন মালি সেখানে কাজ করছেন। সেন্ট্রিকে পরিচয় দিতেই তিনি গেট খুলে দিলেন। সুবর্ণা বুঝতে পারলো আগে থাকতেই তাকে জানিয়ে রাখা হয়েছিলো। আস্তে আস্তে সে বাড়ির ভিতরে ঢুকে গেলো। একজন পরিচালিকা এসে তাকে ডক্টর স্বরূপের কাছে নিয়ে গেলো। সুবর্ণাকে দেখেই তিনি বললেন,
-- বসো মা। যে কাজের জন্য তোমায় এখানে আসতে বলেছি সেই কাজে এর আগে অনেকেই এসেছেন। কিন্তু কারো কাজই সেরকম পছন্দ হয়নি আমার মিসেসের। তাই কটাদিন অন্তর অন্তর লোক পাল্টাতে হয় আমার। আমার মিসেস হাঁটাচলা করতে পারেন না খুব একটা। তাকে দেখাশুনা আর সেবাযত্ন করার জন্য তোমায় আসতে বলেছি। কারণ তুমি বলেছিলে যে কোন কাজ করতে তোমার আপত্তি নেই। তোমার একটাই কাজ সব সময় ওই ঘরে থেকে উনার সমস্ত কিছু করা। তার খাবারটাও ওই ঘরে যে কেউ পৌঁছে দিয়ে আসবে। কিন্তু উনাকে ভুলিয়ে খাইয়ে তোমাকে দিতে হবে। একসময় বিদিশা মানে আমার মিসেস গল্পের বই পড়তে ভালোবাসতেন। তুমি গল্পের বই পড়ে শোনাবে। স্নান করানো, পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রাখার দায়িত্ব সব তোমার। রবিবার আমি নিজের হাতেই এই দায়িত্ব পালন করি।তাই রবিবার তোমার ছুটি। তুমি রবিবার ভোরবেলা বাড়ি যাবে আর সোমবার ন'টার মধ্যে আবার চলে আসবে।
সুবর্ণা এতক্ষণ চুপ করে কথা শুনছিল। এবার সে উঠে দাঁড়িয়ে বললো,
-- চলুন উনার ঘরে যাই।
স্বরূপবাবু সুবর্ণাকে সাথে নিয়ে স্ত্রীর ঘরের দিকে যেতে যেতে বললেন,
--- এক একজন আসে কয়েকদিনের মধ্যেই তাকে চলে যেতে হয়।কারণ আমার মিসেসের পছন্দ হয় না। দেখো চেষ্টা করে যদি তোমাকে তার পছন্দ হয়।
ওরা ঘরের ভিতরে এসে ঢোকেন। স্বরূপবাবু তার স্ত্রীর মাথায় হাত দিয়ে ডাকেন,
-- দিশা দেখো এই মেয়েটি আজ থেকে তোমায় দেখাশুনা করবে। ওর নাম সুবর্ণা। তুমি কথা বলে দেখো ভালো মিষ্টি মেয়ে। আমার মনেহয় তোমার একে খুব ভালো লাগবে।
দিশা সুবর্ণার মুখের দিকে তাকিয়ে চোখের ইশারায় তাকে খাটের উপর বসতে বললেন। কিন্তু সুবর্ণা একটা চেয়ার এনে খাটের পাশে রেখে তাতে বসতে বসতে বললো,
-- অনেকটা জার্নি করে এসেছি। আগে একটু গল্প করি পরে ফ্রেস হয়ে আপনার কাছে গিয়ে বসবো।
সুবর্ণার কথাটা শুনে বিদিশাদেবীর খুব ভালো লাগলো। তিনি ওর কথায় সম্মতি জানিয়ে বলেন,
-- ঠিক আছে। তবে তাই হোক।
স্বরূপবাবু তখন সেখান থেকে বেরিয়ে এসে ড্রয়িংরুমে খবরের কাগজ খুলে নিয়ে বসেন। একটু পরেই তার প্রফেসর ছেলে দেবেশ ঘুম থেকে উঠে ফ্রেস হয়ে বাবার পাশে এসে বসে। বিলাসী চা দিয়ে যায়। এই বিলাসী বহু বছর ধরে স্বরূপবাবুর বাড়িতে আছে। এই বাড়ির প্রত্যেকটা বিষয়ে কথা বলা এবং মতামত দেওয়ার অধিকার সে নিজগুণে অর্জন করেছে। দেবেশ তাকে বহুদিন পর্যন্ত নিজের পিসি বলেই জানতো। বিলাসী চা এনে বাপ ব্যাটার সামনে রেখে বললো,
-- আজও একজন নতুন লোক এলো।কে জানে এ আবার ক'দিন টিকবে।
কথাটা শুনে দেবেশ বলে ওঠে,
-- একে আবার কোথায় পেলে বাবা?
স্বরূপবাবু তখন ছেলের কাছে পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা দিলেন। দেবেশ উদাস হয়ে বলে,
-- দেখো ক'দিন থাকে। মায়ের যে কেন এদের পছন্দ হয় না আমি বুঝতেই পারি না। মা তো শুয়েই থাকেন। হুইল চেয়ার করে শুধু ওয়াশরুমে যাওয়ার সময় সাহায্যের প্রয়োজন। যারা আসে মায়ের সেবা যত্নের কোন ত্রুটি অন্তত আমি খুঁজে পাই না। তবুও কেউ টেকে না।
-- ব্যাপারটা আমার কাছেও বোধগম্য হয় না।
-- এবার মায়ের ঘরে একটা সিসিটিভি লাগিয়ে দাও বাবা।
কথাটা বলেই দেবেশ হো হো করে হেসে ওঠে। ওর বাবাও সেই হাসিতে যোগ দিয়ে বলেন,
-- হ্যাঁ এটাই এখন বাকি আছে -
--- এই ছাড়া আর কোন উপায় নেই বাবা। মায়ের এই মানুষগুলোকে পছন্দ না হওয়ার কারণটা তো আমাদেরও জানা দরকার বাবা।
--- না, এটা মোটেই ঠিক হবে না। দেখি আজ যে এসেছে সে কতদিন টেকে।
ক্রমশ -