Saturday, June 10, 2023

একদিন ভালোবাসবে (৬৬ ও শেষ পর্ব)

একদিন ভালোবাসবে (৬৬ ও শেষ পর্ব)

  কেটে গেছে অনেকগুলি বছর। বাবার মৃত্যুর পর ছ'বছর দীপিকার মা বেঁচে ছিলেন। এখন মেয়ে ডাক্তারী পড়ছে। তাদের সমস্ত খরচ আজও সৌম্য বহন করে চলেছে। সুজয় বারবার দীপিকার দরজা থেকে ফিরে গেছে ভিতরে ঢোকার অনুমতি তার মেলেনি। সুজয়ের বউ সব জানতে পেরে অশান্তির উপর অশান্তি করতে করতে সুজয়কে শেষ পর্যন্ত ডিভোর্স দিয়ে চলে যায়। তা স্বত্তেও দীপিকা আজীবন সুজয়কে ক্ষমা করেনি। কিন্তু মেয়ের সাথে বাড়ির বাইরে সুজয়ের যে কথা হয় তা জানতে পেরেও কোনদিন কোন বাধা যেমন সে দেয়নি ঠিক তেমনই কখনো কোন কথা জিজ্ঞাসাও করেনি। সুজয়ের বারবার অনুরোধ সত্ত্বেও কোনদিন বিন্দুমাত্র কোন টাকা সে হাত পেতে নেয়নি। সুজয় এখন একা, সম্পূর্ণ একা। বাবা,মা দু'জনেই গত হয়েছেন বেশ কয়েক বছর আগেই। মাঝে মধ্যে শরীর খারাপ করলে মেয়েকে জানায়। মেয়েও মাকে বলেই বেরোয় "ও বাড়িতে যাচ্ছি।" দীপিকা কোনদিন কোন বাধা দেয়নি কিংবা ফিরে আসার পরে কোন কথা জানতেও চায়নি। সৌম্য মাঝে মাঝে আসে। তারও যথেষ্ঠ বয়স এখন। তিয়াসার মেয়ে জুইয়ের বিয়ে হয়ে গেছে সে এখন তার স্বামীর কর্মস্থল আমেরিকায় সেটেল্ড। 
  রোজই জুইয়ের যেমন মায়ের সাথে কথা হয় ঠিক তেমনই সৌম্য আঙ্কেলের সাথেও নিত্যদিন কথা হয়। তিয়াসাকে এখন আর আর্থিক দিক থেকে সৌম্যকে কোন রকম সাহায্য করতে হয় না। এখন তার মেয়েই মাকে প্রতি মাসে একটা মোটা অংকের টাকা পাঠায়। কিন্তু আজও সৌম্য তিয়াসার সামান্যতম শরীর খারাপেই ব্যস্ত হয়ে ওঠে। ফোনে গলার আওয়াজই সৌম্যর কাছে তিয়াসা কেমন আছে তার খবর পৌঁছে যায়। 
  সৌম্য ও তিয়াসার জীবন যেন দুটি সমান্তরাল সরলরেখা। একই সাথে এগিয়ে চলেছে কিন্তু কোনদিনও মিলিত হবার নয়। ঈশ্বর পৃথিবীতে এক এক জনকে এক এক রকম কাজ দিয়েই সৃষ্টি করেন। সুন্দর চেহারার অধিকারী, ধনীর দুলাল, ভদ্র,নম্র সৌম্যকে বিধাতা সবকিছু দিয়েও কোথাও যেন একটা ফাঁক রেখে দিলেন। বঞ্চিত করলেন পার্থিব সমস্ত সুখ থেকে। এ জীবনে সৌম্য শুধু দিতেই এসেছে সকলকে। পাওয়ার ভাগ্য নিয়ে সে জন্মায়নি। জীবনে যেটুকু পেয়েছে সে তাতেই তার আত্মতুষ্টি। সম্মান পেয়েছে, ভালোবাসাও পেয়েছে। কিন্তু যে ভালোবাসায় একটা জীবন পরিপূর্ণ রূপ পেতে পারে তা থেকে সে বঞ্চিতই থেকে গেলো আজীবন। বাবা না হয়েও তিয়াসা ও দীপিকার মেয়ের সমস্ত দায়িত্ব বাবার মতোই পালন করেছে সে। দীপিকার রক্তের সম্পর্কের দাদা না হয়েও দাদার দায়িত্ব কর্তব্য থেকে বিন্দুমাত্র সরেনি। বাকি রইলো তিয়াসা! তিয়াসার জন্য তো সে সারাটাজীবনই উৎসর্গ করেছে। সবকিছুর বিনিময়ে সে কী পেলো তবে? আজ একাকী ঘরে ব্যবসার কাজ সেরে সে যখন ফেরে তখন কাজের মাসির হাতের সবটুকু ছাড়া? চোখ বুজলেই আজও তার চোখের সামনে যে নারীটির ছবি ভেসে ওঠে সে তিয়াসা। মাঝে মাঝে নিজের মনকেই সে শান্তনা দেয় হয়ত তিয়াসাকে নিজের করে পেলে এতটা ভালোবাসতে পারতো না। কখনো হয়ত তিয়াসা তার ভালোবাসার সাথে নিলয়ের ভালোবাসার তুলনা করে ফেলতো। সংসার জীবনে খুঁটিনাটি অশান্তি হতোই। তার থেকে যা হয়েছে ভালোই হয়েছে। তিয়াসার প্রতি ভালোবাসাটা দিনরাত বেড়েছে বৈ কমেনি। একটা সময় প্রতিদিন নিয়ম করে সে তিয়াসার বাড়িতেও গেছে শুধুমাত্র তাকে একবার চোখের দেখা দেখতে। বিধাতার লীলা বোঝা দায়! হয়ত তিনি এ জীবনে এটুকুই লিখেছিলেন।
   একদিন ভোরবেলা সৌম্যর কাজের মাসির ফোন পেয়ে হন্তদন্ত হয়ে তিয়াসা সৌম্যর বাড়িতে আসে। কাজের মাসি ওদিকে দীপিকাকেও ফোনে সব জানায়। দু'জনে ঠিক যে অবস্থায় ছিল সেই অবস্থাতেই চলে আসে। দীপিকা মেয়েকে ফোন করে এম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করে। 
  রাতের বেলা শুধুমাত্র এক গ্লাস দুধ খেয়ে শরীর ভালো লাগছে না বলে সৌম্য শুয়ে পড়ে। রান্নার মাসি তার ঘরেই একটা ক্যাম্প খাট পাতিয়ে শোয় সেদিন। কাজের মাসি ঘুম থেকে উঠে সৌম্যর জন্য চা নিয়ে এসে ডাকাডাকি করে শেষে গায়ে ধাক্কা দিয়েও তুলতে না পেরে সকলকে খবর দেয়। নাসিংহোম নিয়ে গেলে তাদের শুনতে হয় "বড্ড দেরি করে ফেলেছেন।" ঘুমের মধ্যেই কাউকে না জানিয়ে কোনরকম কোনভাবেই কাউকেই ছুটাছুটি করতে না দিয়ে সৌম্য চলে যায় যখন পৃথিবীতে সকলের প্রতি তার দায়িত্ব-কর্তব্য সব শেষ হয়ে যায়। আজ তার এই চলে যাওয়াতে অন্যের মানসিক কষ্ট ছাড়া সংসার জীবনে কারো কোন আর অসুবিধা হবে না। কারণ যারা তার প্রতি নির্ভরশীল ছিল আজ সকলেই তাদের সন্তানের দৌলতে দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছে।
  দীপিকা হাউ হাউ করে কাঁদতে থাকে। বাড়ি ভর্তি সকলের চোখেই জল। কিন্তু অদ্ভুতভাবে তিয়াসা নীরব! তার চোখে কোন জল নেই, কারো সাথে কোন কথা নেই একদম চুপচাপ।
  বন্ধু আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে যখন কেউ কেউ ফুলের মালা নিয়ে সৌম্যর বডির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে হাতের ইশারায় দীপিকা সকলকে নিষেধ করে। সে উঠে গিয়ে তিয়াসার হাতে একটা মালা দিয়ে খুব আস্তে আস্তে বলে,
-- দিদি, সৌম্যদা জীবন থাকতে এই জিনিসটিই তোমার হাত দিয়ে চেয়েছিল। কিন্তু মুখ ফুটে কোনদিন বলেনি। আজ তুমি তার সেই ইচ্ছাটি পূরণ করো।
 তিয়াসা রক্তবর্ণ চোখ তুলে দীপিকার দিকে তাকালো। আস্তে করে মালাটা হাতে নিয়ে সৌম্যর নিথর দেহের দিকে এগিয়ে গিয়ে তার গলায় মালা পরিয়ে দিয়ে কিছুক্ষণ এক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থেকে ঠিক তার কাঁধের কাছটাই নিজের মুখটা গুঁজে বসে পড়ে।
  শ্মশানে যাওয়ার সময় হল।দীপিকা তিয়াসাকে তুলতে গেলো। তিয়াসা কাত হয়ে সিমেন্টের উপর পড়ে যায় তখন। দৌড়ে আসলো শ্রেষ্ঠা। নাড়ি ধরে মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়লো। খবর দেওয়া হল মেয়েকে। ডেথ সার্টিফিকেট শ্রেষ্ঠা নিজেই লিখলো। ছুটে এলো পিয়াসা আর তার স্বামী।
 পর পর দুটি কাঁচ ঢাকা শববাহী গাড়িতে করে দুটি মরদেহ চললো। হয়ত তাদের ভালোবাসার প্রতীক্ষা আজই শেষ হল। এপারে যখন মিলন বিধাতা লেখেননি তারা দুজনেই খুঁজে নিলো পরপারের ঠিকানা।

  শেষ।

   বিশেষ ভাবে ক্ষমা প্রার্থী।শেষ পর্বটা দিতে অনেকটাই দেরি করে ফেললাম নানান সমস্যায়।