#আমার_লেখনীতে
প্রথম পরশ
নন্দা মুখাৰ্জী রায় চৌধুরী
কলেজের যে ছেলেটি ছিল প্রতিটা মেয়ের হার্টথ্রব সেই ছেলেটিকেই মানালি একদম সহ্য করতে পারতোনা | ক্লাসটুকু ছাড়া সবসময় রক্তিমকে নিয়ে সবাই গল্পে মজগুল হয়ে আছে | মানালি বুঝতে পারতো রক্তিম এই ব্যাপারটিকে খুব এনজয় করে | আর এটাই ছিল ওর বিরক্তির প্রধান কারন| একটা ছেলে তার নিজস্ব কোন গাম্ভীর্য নেই --- নেই কোন ইচ্ছা অনিচ্ছা | সবসময় মেয়েদের আসরে মধ্যমণি হয়ে বসে আছে | দেখলে মনেহয় যেন কোন পার্সোনালিটিই নেই | ছেলেদের সাথে আড্ডার থেকে মেয়েদের সাথেই আড্ডা দিতে বেশি ভালোবাসে | সেদিন কলেজে ঢুকতে গিয়েই প্রদীপের সাথে দেখা মানালীকে দেখে প্রদীপ বললো ,
--- মানালি কাল আমরা সবাই মিলে সিনেমা দেখতে যাচ্ছি | তুই যাবি তো ?
--- হু যেতে পারি | কিন্তু সবাই মানে কে কে ?
--- এই আট দশজন তো হবেই | রক্তিমও যাবে |
সঙ্গে সঙ্গে মানালির চোয়াল শক্ত হয়ে মাথাটাও গরম হয়ে গেলো |
--- বাহ্ তাহলে তো কলেজের সব মেয়েরাই যাবে বলে মনেহয় | কিন্তু জানিস তো আমার যাওয়া হবেনা |
--- বারে এই যে তুই বললি যাবি?
--- হ্যাঁ যাবো বলেছিলাম কিন্তু তখন তো আমি জানতামনা কলেজের হিরো যাচ্ছে |
প্রদীপ হোহো করে হাসতে হাসতে বললো ,
--- আচ্ছা রক্তিমকে তো সবাই পছন্দ করে তুই কেন ওকে সহ্য করতে পারিসনা ও কিন্তু খুব ভালো ছেলে | মেয়েরা ওকে পছন্দ করে তাতে ওর দোষ কোথায় বল তো ?
--- জানিনা তবে তুই ঠিকই বলেছিস আমি ওকে সহ্য করতেই পারিনা | দেখলে মনেহয় কলির কেষ্ট |
প্রদীপ আবারও হাসতে থাকে |
কিন্তু এই যে মানালি রক্তিমকে পছন্দ করেনা তা রক্তিমেরও কানে পৌঁছেছে | রক্তিমকে দেখলে মানালি সবসময় অন্য রাস্তা ধরে | মুখোমুখি হয়ে গেলে মুখটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে নেয় | একই ক্লাসে একই সাবজেক্ট হওয়া সর্ত্বেও কোনদিন কেউ কারো সাথে কথা বলেনি বা বলার চেষ্টাও করেনি |
লাষ্ট ইয়ার | পরীক্ষা তিনমাস পর | নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহেই সবাই মিলে পিকনিকে যাবে ঠিক হল ডায়মন্ডহারবার | প্রদীপ , রতন , সুহাস সবাই একসাথে মানালীকে বুঝালো ," দেখ পরীক্ষার পর কে কোথায় ছিটকে যাবো জানিনা | অনেকের সাথেই জীবনে আর দেখা হবেনা | পিকনিকে তো সবাই যাচ্ছি শুধু তো রক্তিম একা যাচ্ছেনা | আমাদের এই শেষ কথাটা অন্তত রাখ |" না মানালি ওদের নিরাশ করেনি |
হৈহৈ করে নিদ্দিষ্ট জায়গায় সকলে মিট করে বাসে উঠে পড়লো | প্রায় পঞ্চাশজনের একটা টিম | নিজেরাই নিজেদের গার্জিয়ান | গল্পগুজব , আনন্দফুর্তি বাসের ভিতর চলতে লাগলো | ড্রাইভার জোরে লালেলাপ্পা গান চালিয়ে দিলেন | কেউ কেউ আবার ছিট ছেড়ে চলন্ত বাসের ভিতরই নাচতে শুরু করলো | সবাই খুব এনজয় করতে করতে পিকনিকস্পটে এসে হাজির হল | রাঁধুনি ওদের সাথেই এসেছেন আর হেল্পার ওরা নিজেরাই | বাস ড্রাইভার ভদ্রলোক আর খালাসিও খুব হাসিখুশি | ওদের অনুরোধে উনারাও এসে যোগ দিলেন ওদের পিকনিকে |
সকালের টিফিন পাউরুটি , কলা আর ডিমসেদ্ধ | কেউ আর নিজেরটা খায়না | অন্যেরটা খেতেই যেন বেশি ব্যস্ত | রক্তিম আজ মানালিকে দেখে খুব অবাক হয় | ও আর প্রদীপ দুজনে গোল হয়ে বসা সকলের মধ্যে টিফিনটা ভাগ করছিলো | ওর হাতে এসে মানালিই খাবারটা দেয় | এইপ্রথম দুজন দুজনের মুখের দিকে তাকালো সরাসরি | মানালিই প্রথম হেসে দেয় পরে রক্তিমও একটু মুচকি হাসে | এতো মেয়ে বন্ধু থাকা সত্বেও যা কোনদিন রক্তিমের হয়নি মানালির এই ছোট্ট হাসিটুকু দেখে তার বুকের মধ্যে যেন ধুকপুকানি শুরু হল | নিজেকে সামলে নিয়ে সকলের অলক্ষ্যে সে একাএকাই অনেকটা পথ সেখান থেকে এগিয়ে গেলো |
আর মানালি ---- কোনদিন তো এত কাছ থেকে সে রক্তিমকে দেখেইনি | কি গভীর চোখদুটি ওর --- একমাথা চুল | মুখটা কি নিষ্পাপ --- না , কিছুতেই যেন নিজের মনকে কন্ট্রোল করতে পারছেনা | রক্তিমের কাছ থেকে তাকে এই মুহূর্তে একটু দূরে সরে যেতে হবে | একা একাই নদীর পার ধরে হাঁটতে হাঁটতে একটা বড় বটগাছ পেয়ে সেখানে বসে একমনে নদীর দিকে তাকিয়ে রক্তিমেরই কথা ভাবতে থাকে | কি আছে রক্তিমের মধ্যে যে মেয়েরা তারজন্য এতো পাগল কিন্তু আজ কেন ওকে এতো কাছ থেকে দেখে -----
--- বসতে পারি ?
রক্তিমের গলার আওয়াজে আবার মানালির বুকের মধ্যে যেন ধুকপুকানি শুরু হল | মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো | রক্তিম একদম গা গেসে বসে পড়লো | দুজনেই চুপ | আজ সকাল থেকে বেশ হিমেল হাওয়া হচ্ছে তারউপর নদীর পার | রক্তিম মানালির দিকে তাকিয়ে দেখে সে রীতিমত কাঁপছে | গায়ে কোন শীতবস্ত নেই | আসলে ওরা যখন বাস থেকে নেমে পিকনিক স্পটে এসেছিলো তখন অনেকেই সোয়েটার চাদর খুলে একটা জায়গায় জমা করে রেখে দিয়েছিলো | কিন্তু রক্তিমের জ্যাকেটটা পরাই ছিল | সে তাড়াতাড়ি নিজের জ্যাকেটটা খুলে মানালিকে সেটা পরে নিতে বলে | মানালিও বাধ্য মেয়ের মত জ্যাকেটটা গায়ে পরে নেয় | কিন্তু তবুও তার কাঁপুনি বন্ধ হয়না | রক্তিম কি করবে কিছুই বুঝতে পারেনা | হঠাৎ করেই সে মানালিকে দুইহাতে বুকের সাথে চেপে ধরে | মানালি সহজেই আত্মসমর্পণ করে | রক্তিম তার মুখটা ধরে নিজের ঠোঁটদুটো মানালির ঠোঁটের উপর রাখে | পরপর মানালির ঠোঁটের উপর ভালোবাসার চিহ্ন এঁকে দিতে থাকে |মানালি চোখ বন্ধ করে থাকে | কিছুক্ষণ পর মানালির কম্পন বন্ধ হয় | রক্তিম তাকে বাহুমুক্ত করে বলে ,
--- ক্ষমা করে দিও | পরিস্থিতির চাপে পড়েই আমি একাজ করতে বাধ্য হয়েছি | সব মেয়েরাই আমার বন্ধু ঠিকই কিন্তু আমি কোন মেয়েকে কখনও অসম্মান করিনি |
অপরাধীর মত মুখটা নিচু করে দাঁড়িয়ে পরে | মানালিও ওকে উঠতে দেখে নিজেও উঠে পরে |
--- তুমি এগিয়ে যাও আমি একটু পরে আসছি |
মানালি কিছুটা এগিয়ে গিয়ে আবার পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে পরে |
রক্তিম দ্রুত তার দিকে এগিয়ে গিয়ে বলে
--- কিছু বলবে ?
-- হু
--- বলো
মানালি জ্যাকেটটা খুলে রক্তিমের হাতে দিয়ে বলে
--- এটা আমার গায়ে থাকলে ওরা --
--- হ্যাঁ হ্যাঁ ঠিক বলেছো --- দাও -- কিন্তু একটা কথা ছিল যদি কিছু মনে না করো
--- বলো
সরাসরি মুখের দিকে তাকিয়ে মানালি বললো
-- আমারও একটা কথা ছিল | আমাদের আবার কবে দেখা হবে ?
--- এক্সাক্টলি এই কথাটাই আমিও বলতে চেয়েছিলাম |
দুজনেই একসাথে হেসে দেয় | রক্তিম মানালির হাতদুটো ধরে বলে ,
--- দেখা আমাদের প্রায়ই হবে | আর আজকের দিনটার এই কিছুক্ষণ সময়কে সারাজীবনের জন্য ধরে রাখতে তুমি আমায় সাহায্য করবেতো?
--- বুঝতে পারোনি কি তখন ? মুখেই বলতে হবে ?
রক্তিম হেসে দেয় | কিন্তু আমারটা পাওনা থাকলো |
লজ্জায় লাল হয়ে ওঠে মানালি |
--এবার তুমি এগিয়ে যাও| এতক্ষণ সবাই খুঁজতে শুরু করে দিয়েছে হয়তো | আমি একটু পরে আসছি |
--- ঠিক আছে কিন্তু বেশি দেরি কোরোনা কিন্তু |
শেষ